অদম্য মেয়ের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ ফুটবলে উড়তে পারে বাংলাদেশের পতাকা!

অনূর্ধ্ব ১৬ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক মারিয়া মান্দা। ছবি: শামসুল হক
অনূর্ধ্ব ১৬ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক মারিয়া মান্দা। ছবি: শামসুল হক
>এএফসি অনূর্ধ্ব ১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডে স্বাগতিক মিয়ানমারকে ১-০ গোলে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই জয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়ার সেরা আটে জায়গা করে নিয়েছে লাল-সবুজরা। চূড়ান্তপর্বের সেরা তিনটি দল খেলবে অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপে। চতুর্থ হওয়া দলটির সামনেও প্লে অফ খেলে সুযোগ থাকবে বিশ্বকাপ খেলার।

‘দিদি’ হবে তো?

এক গাল হাসি দিয়ে ‘দাদা! হবে, হবে, হবে।’

প্রশ্নটি পুরোপুরি খুলে বলতে হয়নি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে ‘হবে তো’ মলাটের প্রশ্নটা ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী দলের অধিনায়ক মারিয়া মান্দা। জবাবে এই প্রতিবেদককে আশ্বস্ত করে তিনবার বলেছিলেন ‘হবে।’ দলের ওপর কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে একজন অধিনায়ক নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন, এএফসি অনূর্ধ্ব ১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলবেই বাংলাদেশ। আজ বোঝা গেল ফাঁকা বুলি ওড়ানোর মেয়ে মারিয়া নন, যা বলে-তা করে দেখানো সামর্থ্যও রাখে তার দল। যেমন অধিনায়ক, তেমন তার দল।

ঘরের মাঠে বাছাইপর্বের প্রথম রাউন্ডের বাধা অনায়াসে পার হয়ে যাওয়ার পর মারিয়াদের ওপর আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল ঠিকই। কিন্তু উল্টো পিঠেই কত শঙ্কা, কত উদ্বেগের চোরাস্রোত! মিয়ানমারের মাটিতে পারবে তো বাংলাদেশের মেয়েরা? লড়াইটা হবে ‘সেয়ানে সেয়ানে।’ বাংলাদেশের গ্রুপে আছে ফিলিপাইন, স্বাগতিক মিয়ানমারসহ শক্তিশালী চীন। প্রাচ্যের চীন পর্যন্ত যেতেই হলো না। এর আগেই ফিলিপাইন ও মিয়ানমারকে টানা দুই ম্যাচে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়ার সেরা মঞ্চ নিশ্চিত করল বাংলাদেশ।

সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য টুর্নামেন্টে আগেই জায়গা ঠিক করে রেখেছে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন উত্তর কোরিয়া, রানার্সআপ দক্ষিণ কোরিয়া, তৃতীয় জাপান ও স্বাগতিক থাইল্যান্ড। এই দলগুলোর সঙ্গে যোগ হবে দ্বিতীয় পর্বের সেরা চার দল। এক ম্যাচ হাতে রেখেই ইতিমধ্যে টিকিট নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ ও চীন। বাকি দুইটি দলও নিশ্চিত হওয়ার পথে। আট দলের এএফসি চ্যাম্পিয়নশিপ শুধুই চূড়ান্ত পর্বের লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এখান থেকে সেরা তিনটি দল খেলবে ২০২০ অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ। মারিয়ার নেতৃত্বে পারবে তো বাংলাদেশ?

মারিয়া মান্দা। ফাইল ছবি
মারিয়া মান্দা। ফাইল ছবি



এশিয়ার সেরা আটে জায়গা করে নিয়ে এক লাফে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নটা বাড়াবাড়িই। তবে মারিয়া তো হার মানার নয়। মারিয়ার জীবনের গল্পের পরতে পরতে তো লেখা আছে এক সংগ্রামী মেয়ের হার না মানার গল্প। যে গল্পটা হতে পারে দেশের মেয়েদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

বাবা মারা গেছেন, বিষয়টি বোঝার বয়সও তখন হয়নি ছোট মেয়েটির। স্বামীকে হারিয়ে জীবনের উত্তাল সাগরে নাও ভাসিয়েছেন মা এনাতো মান্দা। সহায়-সম্বল বলে কিছু নেই বলে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে কাজ নিলেন গৃহপরিচারিকার। আর যা-ই হোক, ছেলেমেয়েদের মুখে তো তুলে দিতে হবে দুমুঠো ভাত। টিকিয়ে রাখতে হবে তাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন। সেই ছোট মেয়েটি আজকের মারিয়া। কত বাধা পাড়ি দিয়ে এসে নিজেকে একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তৈরি করা যায়, তা মারিয়ার জীবনগল্পের প্রতিটি প্যারাতে লেখা।

বাবা বীরেন্দ্র মারাতের কথা জিজ্ঞাসা করা হলে হা করে তাকিয়ে থাকে মারিয়া। বাবার কোনো স্মৃতিই যে নেই তার। মা এনাতোই একসঙ্গে তার ‘বাবা ও মা’। মারিয়াদের তিন বোন ও একমাত্র ভাইকে মানুষ করতে কী অমানুষিক কষ্টই না করেছেন এনাতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন, তা দিয়েই মারিয়াদের চার ভাইবোনের জুটত দুমুঠো ভাত। অনেক দিন তো মা ও বড় বোনের সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে হয়েছে মারিয়াকেও। যে মারিয়ার ফুটবলের বাইরের জীবনটা কষ্টের কালো ডায়েরি।

ফুটবলটাই মারিয়ার জীবনে ফুটিয়েছে হাসি। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট উপলক্ষে খালি পায়ে ফুটবলে হাতে খড়ি হয় ময়মনসিংহ জেলার মেয়েটির। ২০১৩ সালে ধোবাউড়ার বিখ্যাত কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলের সদস্য। এর পরেই তার পায়ে ওঠে বুট। আর বদলাতে থাকে মারিয়ার পৃথিবী। হ্যাঁ, তখনো কিন্তু মারিয়াকে পাশের বাড়িতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে গৃহপরিচারিকার কাজে হাত লাগাতে হতো।

২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় দলে ডাক পায় মারিয়া। তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে তার সহ-অধিনায়কত্বেই চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। গত বছর ঢাকায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন দলের সহ-অধিনায়কও ছিল মারিয়া। এরপরে জায়গা করে নেয় মূল জাতীয় দলে। শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত সাফে বাংলাদেশের রানার্সআপ হওয়ার পেছনে ছোট মারিয়ার অবদান কম নয়। যার ফল স্বরূপ কিশোরীদের অধিনায়ক।

মাঠে অধিনায়ক মারিয়ার খেলার ধরনটা পাক্কা রাঁধুনির মতো। তাকে কিছুটা মেলানো যায় স্পেন ও বার্সেলোনার মিডফিল্ডার সার্জিও বুসকেটসের সঙ্গে। পা থেকে বল কেড়ে নিতে হবে, সেখানে মারিয়া। আবার মাঝমাঠে বল দখলে রাখতে হবে, সেখানেও আছে খর্বাকৃতির মেয়েটি। বল পায়ে নাও, প্রয়োজন হলে হোল্ড কর, সুযোগ হলে দ্রুত উইংয়ে ভালো একটি পাস দাও। এক কথায় সাধারণ ফুটবল। কিন্তু কজনই-বা পারে এভাবে খেলতে? মারিয়া মান্ডা এত সহজভাবে দারুণ খেলতে পারে বলেই তো সে আলাদা।

এএফসি চ্যাম্পিয়নশিপ নিশ্চিত করার আগে মারিয়ার নেতৃত্বে ২০১৭ সালে ঘরের মাঠে অনূর্ধ্ব ১৫ সাফে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। দরিদ্র ঘরে জন্ম, পরিবারের জন্য গৃহপরিচারিকার কাজে সহযোগিতা, তবুও কত বাধা পেরিয়ে আসা এক চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক পেয়েছে বাংলাদেশ। তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ এসেছে। কাজটি অনেক কঠিন। কিন্তু মারিয়ার জীবনের গল্পটাই বলছে তাঁর নেতৃত্বে এশিয়ান কিশোরী ফুটবলে নাড়া দিতে যাচ্ছে লাল-সবুজরা।

বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্ন হেসে উড়িয়ে দেওয়ার আগে মারিয়ান কথাগুলো শুনুন। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মারিয়া তার লেখনীতে বলেছিল, ‘আমি স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশের মেয়েরা একদিন ফুটবলে বিশ্বকাপের জন্য লড়বে। আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা হয়েছি। এএফসি কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসিয়ান, এশিয়ার মধ্যাঞ্চলের দেশগুলোকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছি। দেখিয়ে দিয়েছি বয়সভিত্তিক ফুটবলে আমরাই এই অঞ্চলের সেরা। এখন আমাদের লক্ষ্য বিশ্বকাপে খেলা। আমরা বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়ার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’