রিয়াল-বিপর্যয়ের পেছনের পাঁচ কারণ

রিয়ালের সামনে ঘোর অমানিশা। ছবি: এএফপি
রিয়ালের সামনে ঘোর অমানিশা। ছবি: এএফপি
>টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর যেন পচন ধরেছে রিয়াল মাদ্রিদ স্কোয়াডে। রোনালদো-জিদান নেই, নাভাস-মার্সেলোরা থেকেও নেই। লিগে অবস্থা তথৈবচ, যে চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়ে রিয়ালের গর্ব ছিল আকাশছোঁয়া, সে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকেও বাদ পড়েছে দৃষ্টিকটুভাবে। কিন্তু এমন কেন হচ্ছে? এর পেছনে কারণ কী কী?

এমনটা যে হবে সেটা মোটামুটি আগেই বোঝা গিয়েছিল। রিয়ালের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ক্লাবের অন্যান্য কর্তাব্যক্তিরা মৌসুম শুরু আগে থেকেই বলে দিয়েছিলেন, এই মৌসুমটা হবে পরিবর্তনের। আর এই পরিবর্তনের শুরুটা হয়েছিল জিনেদিন জিদান যাওয়ার মাধ্যমে। যে জিদান রিয়ালকে টানা তিনটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়ে দিয়ে গেছেন। জিদানের পথ ধরে দলের সবচেয়ে বড় তারকা রোনালদোও ক্লাব ছেড়ে চলে গেলে আস্তে আস্তে বোঝা যায়, নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে রিয়াল। কিন্তু নতুন যুগে প্রবেশের এই সময়টা এমন তিক্ততায় ভরা হবে তা কে জানত?

জিদানের ব্যাপারে আগেই বললাম। তিনি আগেই বুঝেছিলেন, এই স্কোয়াড তার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে পৌঁছে গেছে। আর শিখরে পৌঁছে যাওয়ার পর শুধু একদিকেই যাওয়া যায়, নিচের দিকে। এটা জিদান বুঝেছিলেন। ক্লাব সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজকে জিদান অনুরোধ করেছিলেন গ্যারেথ বেলকে ছেড়ে দিয়ে হলেও রোনালদোকে রেখে দেওয়া হোক। কিন্তু সে অনুরোধে কাজ না হওয়াতেই ওভাবে চলে গেছেন জিদান। কারণ ফ্রেঞ্চ কিংবদন্তি বুঝতে পেরেছিলেন, রিয়ালের মেরুদণ্ড ক্ষয়ে গেছে। রোনালদো না থাকলে সেটা আর আড়াল করা যাবে না। তাই মানে মানে কেটে পড়েছেন। জিদান যে ভুল ছিলেন না, এই মৌসুমের প্রতি মুহূর্তে সেটা বুঝতে পারছে রিয়াল। আয়াক্সের সঙ্গে প্রথম লেগ জিতলেও নিজেদের মাঠে দ্বিতীয় লেগে বাজে ভাবে হেরে গিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বাদ তো পড়েছেই, এই মৌসুমে ঘরোয়া লিগ জেতারও আশা নেই তাদের। গত মৌসুমে যখন রোনালদো-জিদানরা ছিলেন, তখন কি ঘুণাক্ষরেও বোঝা গিয়েছিল যে সামনের বছরে দলের অবস্থা এত খারাপ হবে?

কিন্তু রিয়ালের এই বেহাল অবস্থা হচ্ছে কেন? কিছু কারণ দেখে নেওয়া যাক!

কার্যকর কোচ না থাকা
জিদান রিয়ালের কেমন কোচ ছিলেন, সে সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। হয়তো কৌশলগত দিক দিয়ে সেরা কেউ ছিলেন না, কিন্তু জিদান অবশ্যই জানতেন কীভাবে ট্রফি জিততে হয়। জিদান যাওয়ার পর রিয়াল মাদ্রিদ এমন কাউকে পায়নি যে একই সঙ্গে তারকা খেলোয়াড়দের সামলাতে পারে ও নতুন প্রতিভাদের সম্যকভাবে সুযোগ দিতে পারে। জিদান যেমন ছিলেন। রোনালদো, রামোস, ক্রুস, মদরিচ, মার্সেলোদের অহংবোধ সামলিয়ে একটা দল হিসেবে খেলাতে যেমন পারতেন। আবার অ্যাসেনসিও, কাসেমিরো, ভাসকেজদের মতো খেলোয়াড়দের প্রতিভার সদ্ব্যবহারও ঘটেছে তাঁর আমলেই। জিদান যাওয়ার পর হুলেন লোপেতেগি বা সান্তিয়াগো সোলারি, কেউই এই দুইয়ের সম্মিলন ঠিকভাবে করতে পারেননি। লোপেতেগি ভিনিসিয়ুসের মতো প্রতিভাকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখতেন, এদিকে সোলারি ম্যাচের পর ম্যাচে ফর্মহীন তারকাদের খেলিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে ইসকো বা ফেদেরিকো ভালভার্দের মতো ফর্মে থাকা খেলোয়াড়েরা বেঞ্চ গরম করছেন।

খেলোয়াড়দের ফর্মহীনতা
রোনালদো যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী দলটার বাকি সদস্যরাও যেন খেলতে ভুলে গেছেন। ব্যালন ডি’অর জয়ী লুকা মদরিচের ওপর এখন আয়াক্সের বিশ বছর বয়সী তারকা ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং ছড়ি ঘোরান, গা-ছাড়া খেলা দিয়ে নিয়ত সমালোচিত হচ্ছেন টনি ক্রুস। ওদিকে বিশ্বকাপ জেতার পর ডিফেন্ডার রাফায়েল ভারানের খেলতে খেলতে যেন অনুচ্চারে বলেন, ‘এই বয়সেই সব তো জিতে গেছি, আর কী চাই জীবনে!’ বাজে খেলে খেলে মূল দল থেকে ছিটকে গেছেন মার্সেলো, এখন রিয়ালের লেফটব্যাক হিসেবে খেলেন সার্জিও রেগুলিয়ন। ঢিমেতালে খেলতে গিয়ে দলের ছন্দই নষ্ট করে দিচ্ছেন কাসেমিরো। কোচের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ার কারণে বেঞ্চ গরম করছেন ইসকো। গ্যারেথ বেল একদিন মাঠে থাকেন, তো দুই দিন তাঁকে দেখা যায় হাসপাতালে। দলের মূল তারকা হতে গেলে যেমন পারফরম্যান্স দিতে হয়, তা দিতে বেলের বড় অনীহা। শুধুমাত্র বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়াকে এই মৌসুমে আনা হয়েছে দেখে তাকে খেলানো হচ্ছে ম্যাচের পর ম্যাচ। যে কেইলর নাভাস দলের নাড়ি-নক্ষত্র জানেন, এখন তাঁর অবস্থান বেঞ্চে। তাদের জায়গায় উল্টো যারা সুযোগ পাচ্ছেন, তারা জানপ্রাণ দিয়ে খেলে যাচ্ছেন—যেমন ভিনিসিয়ুস, ভালভার্দে, রেগুলিয়ন প্রমুখ। বেনজেমা ভালো খেললেও, রোনালদোর সমান কি আর কখনো হতে পারেন! এভাবেই খেলোয়াড়দের ফর্মে না থাকার মাশুল দিচ্ছে রিয়াল।

রোনালদোর যোগ্য উত্তরসূরি না নিয়ে আসা
কিছুদিন আগে লুকা মদরিচের একটা বক্তব্য উল্লেখ করা যাক এখানে, ‘যে কোনো দলই রোনালদো না থাকার অভাব টের পাবে, কেবল আমরাই নই। সে যখন চলে গেল, ক্লাব ভেবেছিল দলের বাকি খেলোয়াড়েরা তার অভাব পূরণ করতে পারবে। নিজ নিজ পারফরম্যান্সের মান বাড়াবে। ক্রিস্টিয়ানো প্রতি মৌসুমে ৫০টা করে গোল করত। প্রতি মৌসুমে ৫০টা করে গোল করে এমন খেলোয়াড় আপনি আর পাবেন না। আমি নাম উল্লেখ করব না, কিন্তু দলের কিছু খেলোয়াড়ের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল ৫০টি না হোক, অন্তত ১৫-২০টা গোল তারা করবেই। কিন্তু তারা সেটি করতে পারেনি। আর এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন।’ মদরিচের কথাতেই স্পষ্ট, রোনালদোর উত্তরসূরির খোঁজ এখনো পায়নি রিয়াল। রোনালদো যাওয়ার পর মনে করা হয়েছিল, কিলিয়ান এমবাপ্পে, নেইমার বা এডেন হ্যাজার্ডের মতো কোনো তারকাকে আনা হবে দলে। কিন্তু কাউকে না এনে রিয়াল সভাপতি ভেবেছিলেন, দলে থাকা এক কালের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় গ্যারেথ বেল রোনালদো অভাব পূরণ করবেন। কিন্তু বেল তো বটেই, আক্রমণভাগের আর কোনো খেলোয়াড়ই রোনালদোর অভাব ঘোচাতে পারছেন না। যার দাম চুকাচ্ছে রিয়াল।

রিয়াল সভাপতির আকাশ-কুসুম পরিকল্পনা
ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ রিয়ালের সভাপতি হিসেবে আছেন, কম দিন হলো না। এর আগেও ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সাত বছর রিয়ালের সভাপতি ছিলেন। বর্তমান মেয়াদে সভাপতি আছেন, তাও ২০০৯ সাল থেকে। রিয়ালের সামগ্রিক সাফল্যের পেছনে পেরেজের অবদান অনস্বীকার্য। পেরেজ সভাপতি থাকা অবস্থায় রিয়াল লিগ জিতেছে পাঁচবার, কোপা দেল রে জিতেছে দুইবার, সুপারকোপা জিতেছে চারবার, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে পাঁচবার, ক্লাব বিশ্বকাপ ও উয়েফা সুপার কাপ জিতেছে চারবার করে। আক্ষরিক অর্থে পেরেজের এখন হয়তো মনে হচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ স্কোয়াডের পেছনে আগের মতো টাকা ঢালার দরকার নেই। যে কারণে রোনালদোর বিকল্প হিসেবে নেইমার, এমবাপ্পে ও হ্যাজার্ডকে আনার পেছনে তাঁর তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তিনি এখন চাইছেন আক্ষরিক অর্থেই রিয়াল ইতিহাসে নিজেকে অমর করে রাখতে। নতুন স্টেডিয়াম বানানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। যে স্টেডিয়ামের সম্ভাব্য নাম হবে পেরেজের নামেই। এই আকাশ-কুসুম পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য খেলোয়াড় কেনাতে একটু লাগাম দিয়েছেন পেরেজ, রোনালদো যাওয়ার পরেও। ফলে এ কারণেও ভুগছে রিয়াল।

মূল একাদশের গড় বয়স
রিয়াল যে তরুণ খেলোয়াড় কিনছে না, বা তাদের স্কোয়াডে যে তরুণ খেলোয়াড় নেই, তা কিন্তু নয়। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, সার্জিও রেগুলিয়ন, ফেদেরিকো ভালভার্দে, মার্কো অ্যাসেনসিও, মার্কোস ইয়োরেন্তে, আলভারো ওদ্রিওসোলা, দানি সেবায়োস, ব্রাহিম দিয়াজ—প্রতিভাবান তরুণের অভাব নেই রিয়ালের। কিন্তু ভিনিসিয়ুস ছাড়া সবার ঠিকানা বেঞ্চ। মূল একাদশে এদের কেউই নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছেন না। কাসেমিরো, ক্রুস, মদরিচরা ভালো না খেললেও ম্যাচের পর ম্যাচ কোচ তাদেরই খেলিয়ে যাচ্ছেন। ফলে রিয়ালের মূল একাদশের গড় বয়স বেড়ে গেছে, ‘বুড়িয়ে’ গেছে রিয়ালের স্কোয়াড।