'ভার্গি টাইম' আর 'ওলে ওলে'

চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ার পর এমন একটি ছবির বড় দরকার ছিল। ছবি: টুইটার
চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ার পর এমন একটি ছবির বড় দরকার ছিল। ছবি: টুইটার

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্ত হতে হবে না, গত দুই যুগ ধরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দেখাও লাগবে না। ইংলিশ ফুটবল নিয়ে মোটামুটি জ্ঞান থাকলেই শব্দজোড়াটা চেনেন, ‘ফার্গি টাইম।’ নিজেদের মাঠে ইউনাইটেড অসুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেই ডাগ আউটে লাফ ঝাঁপ আর গলা চড়ে যেত স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের। কথার তুবড়ি আর কড়া মেজাজের সামনে রেফারিরা যোগ করা সময়টাও কেন যেন একটু বেশি দিতেন! আর ওই সময়েই কীভাবে যেন ম্যাচের ফলটা নিজেদের দিকে এনে ফেলত ইউনাইটেড। রেড ডেভিলরা ভালোবেসে এ বাড়তি সময়কেই ডাকে ‘ফার্গি টাইম’।

কাল চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষ ষোলোর দ্বিতীয় লেগে সে সময়টাই ফিরে এসেছিল। প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের মাঠে ৯৩ মিনিটেও ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল ইউনাইটেড। কিন্তু দুই লেগ মেলাতে গেলে এ ফলেও লাভ হতো না। নিজেদের মাঠে যে ২-০ ব্যবধানে হেরে বসে আছে তারা। ওই সময়েই পেনাল্টি পেল ইউনাইটেড। স্বাভাবিক পেনাল্টি নয়, ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারিংয়ের সুবাদে পাওয়া সেটি। সংক্ষেপে ‘ভার’ নামে পরিচিত প্রযুক্তির সুবাদে পেনাল্টি পায় ইংলিশ ক্লাবটি। ভয়ংকর চাপ নিয়ে পেনাল্টি নিতে এগিয়ে এলেন ২১ বছর বয়সী মার্কাস রাশফোর্ড।

মাঠে থাকা এ প্রজন্মের অন্য বিস্ময় বালক কিলিয়ান এমবাপ্পেকে তাঁর উঠোনেই হতাশায় ডুবিয়ে জায়গা মতো বল পাঠিয়ে উন্মাতাল উদ্‌যাপনে মাতলেন রাশফোর্ড। মাঠে, ডাগ আউটে আর মাঠের বাইরে থাকা খেলোয়াড়, গ্যালারি ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে পণ্ডিত হিসেবে থাকা সাবেক ইউনাইটেড খেলোয়াড়ের মধ্যে তখন কোনো পার্থক্য নেই। জেসি লিনগার্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাগলাটে উদ্‌যাপন করছেন। রাশফোর্ডরা মাঠেই। বিটি স্পোর্টসে ছোট বাচ্চার মতো লাফাচ্ছেন রিও ফার্ডিনান্ড। প্যাট্রিক এভরা আর এরিক ক্যান্টোনা সে তুলনায় ভাগ্যবান। মাঠেই এমন একটা জয় দেখলেন। ভারের কল্যাণে ফার্গি টাইমের গোল অবশ্য নতুন নাম পেয়েছে, ভার্গি টাইম।

সেও কেমন জয়? নিজেদের মাঠে ২-০ হেরে গেছে ইউনাইটেড। ওলে গুনার সুলশ্যারের বদলে যাওয়া ইউনাইটেডের স্বপ্নযাত্রা সেদিনই ধাক্কা খেয়েছিল। নিজেদের মাঠে ২-০ হেরে যাওয়া দলটি কীভাবে প্যারিসে জয় পাবে? চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে ঘরের মাঠে ২ গোলের ব্যবধানে হেরে কেউ পরের রাউন্ডে যেতে পারেনি। আর নিজেদের মাঠকে যে দুর্গ বানিয়ে রেখেছে পিএসজি। বার্সেলোনা ও বায়ার্ন মিউনিখের মতো দল এ মাঠে ৪ ও ৩ গোল খেয়েছে। লিভারপুল এ মৌসুমেই হেরে এসেছে। সেখানে মার্শিয়াল, পগবা, লিনগার্ডের মতো তিন খেলোয়াড়কে রেখে যেতে হয়েছে ইউনাইটেডের। এ ম্যাচে ফেবারিট কারা ছিল সেটি না বললেও চলে।

এমন সময়ে দলের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল দুজন। স্যার ফার্গুসন ও স্বয়ং সুলশ্যার। ইউনাইটেড ক্যারিয়ারের পুরোটা দলকে সব সময় শেষ মুহূর্তে বাঁচানোর জন্য বিখ্যাত ছিলেন সুলশ্যার। আর অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের সব গল্পগুলো যেন শেষ হয়ে গিয়েছিল ফার্গুসনের বিদায়েই। ম্যাচের আগে তাই দলের সঙ্গেই প্যারিসে গিয়েছেন ফার্গুসন। এ দুজনই তো ২০ বছর আগে ইউনাইটেড এনে দিয়েছিলেন ‘ট্রেবল’ জেতা বছরের চ্যাম্পিয়নস লিগটি। বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে যোগ করা সময়ে করা দুই গোলের দ্বিতীয়টি ছিল এই সুলশ্যারের। ডাগ আউটে ছিলেন ফার্গুসন। কাল আরেকটি যোগ করা সময়ের গোলের মুহূর্তেও ছিলেন এ দুজন!

এমন এক জয়ের পর এখন চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার স্বপ্নও দেখছেন সুলশ্যার, ‘এটাই চ্যাম্পিয়নস লিগ, এখানেই এসব হয় (এমন অবিশ্বাস্য কিছু)। এটাই এ ক্লাব, এটাই আমরা, এটাই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।’ ক্লাবের ফ্রেঞ্চ কিংবদন্তি কান্টোনাও উপভোগ করছেন এমন মুহূর্ত, ‘দারুণ ভালো লাগছে। আমি খুব খুশি।’ বর্তমান খেলোয়াড়দের কৃতিত্ব দিতেই হচ্ছে এমন এক জয়ের পরও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় পেয়েছেন তাঁরা। গর্বিত অ্যাশলে ইয়ং এক কথায় বলেছেন, ‘আজ রাতে অসাধারণ এই ক্লাবের অধিনায়ক হতে পেরে খুব খুবই গর্বিত। কী একটা রাত, আমরা সব সময় বিশ্বাস রেখেছিলাম।’ বিশ্বাস রাখার কথা শোনা গেল দুই গোল করে স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখা লুকাকুর কণ্ঠেও, ‘এমন সব মুহূর্তে নিজের ওপর বিশ্বাস রাখাই পার্থক্য গড়ে দেয়। দল নিয়ে আমি গর্বিত।’

ইউনাইটেডের এমন কিছু করতে পারে এ বিশ্বাসটাই হারিয়ে গিয়েছিল। হোসে মরিনহোর অধীনে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল দলটি। সে দলেই প্রাণ এনে দিয়েছেন জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পাওয়া সুলশ্যার। ম্যাচ শেষে তাই ক্লাব কিংবদন্তি গ্যারি নেভিল সোজা সাপটা প্রশ্ন করেছেন সাবেক সতীর্থকে, ‘ওলে গুনার, তোমার কাছে আমার তিনটা প্রশ্ন আছে। চুক্তিতে কয় বছর চাও? তোমার বেতন কত লাগবে? আর তোমার মূর্তিটা কোথায় গড়বে?’

মজার মুহূর্ত পার করার পরও নিজের দাবিতে অটল ছিলেন নেভিল। ‘ওলে’কেই ইউনাইটেডের দায়িত্ব দেওয়া হোক আগামী মৌসুমে, ‘দলের ফর্মই সব বলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিরতিতেই (মার্চে) তাকে এ চাকরি না দিলে আমি খুব অবাক হব।’