কৈরালাদের স্মৃতির শহরে বড় সাফল্যের লক্ষ্য মেয়েদের

নেপালে সাফ জিততে চায় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।
নেপালে সাফ জিততে চায় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।
>মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ হচ্ছে নেপালের বিরাটনগরে। কাঠমান্ডুর তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে থাকা এই শহরটি নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার স্মৃতিবিজড়িত শহর।

শহরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে শাকিরার গাওয়া বিখ্যাত গানটা। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আগে তৈরি থিম সং ‘দিস টাইম ফর আফ্রিকা’ মাইকে বাজানো হচ্ছে। বাংলাদেশের জেলা শহরের জনপ্রিয় যানবাহন অটো রিকশার মতো ছোট গাড়িতে এভাবেই চলছে মেয়েদের পঞ্চম সাফের প্রচারণা। নেপালের বিরাটনগরের শহীদ রঙ্গশালায় (স্থানীয় ভাষায় স্টেডিয়ামকে বলে রঙ্গশালা) এবারের মেয়েদের সাফ টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে গতকাল।
একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য মোটেও উপযোগী শহর বলা যাবে না বিরাটনগরকে। নেপালের একেবারে দক্ষিণের শহর। কাঠমান্ডু থেকে বাসের ভ্রমণে ঘণ্টা দশেক লেগে যায়। বিমানে আধঘণ্টা। ঢাকা থেকে গতকাল যখন কয়েকজন সহকর্মীদের সঙ্গে চেপে বসলাম বাংলাদেশ বিমানে, মনের মধ্যে ভয় আর উৎকণ্ঠা। কারণ কাল যে ছিল সেই ১২ মার্চ। গত বছর এই দিনেই কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরেই ঘটে গিয়েছিল ভয়ংকর বিমান দুর্ঘটনা। আমাদের বিমান বিজি ০০৭১ এর পাইলট তানিয়া যখন কাঠমান্ডুর আকাশে এসে ঘোষণা করলেন, বিমান নামার সংকেত পাচ্ছে না, অনেকেই দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করলেন। অবশ্য প্রায় আধঘণ্টা বাড়তি সময় আকাশে চক্কর দিয়ে অবশেষে বিমান নিরাপদেই নেমেছিল। এরপর ভিসার আনুষ্ঠানিকতা, ডলার ভাঙানো ও স্থানীয় সিম কেনার পালা। এগুলো শেষ করতে করতে কখন যে কাঠমান্ডু টু বিরাটনগর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের সময় শেষ হতে চলেছে, খেয়ালই করিনি। শেষ পর্যন্ত বোর্ডিং পাস নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বিরাটনগরের বিমানে চেপে বসা।

ঘুম ঘুম চোখেই দেখা যাচ্ছিল নিচের সবুজ ধানখেত, পাহাড় আর ছোট্ট এক চিলতে শহর। একেবারে বাংলাদেশের মফস্বল শহরের মতোই। কোনো উঁচু ভবন নেই। শান্ত, নিরিবিলি। শহরের জনসংখ্যা মাত্র ২ লাখ ৪০ হাজার। নেপালের শিল্প নগরী নামেই পরিচিত বিরাটনগর। শহরে পা রেখে বোঝা গেল না এখানে হচ্ছে মেয়েদের সাফ। শুধু বিমানবন্দরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের পাশে ছোট একটা সাইনবোর্ডে অংশ নেওয়া ছয়টা দেশের পতাকা আঁকা রয়েছে। ব্যস, এতটুকুই। শহরের মোড়ে মোড়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার পরামর্শ প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ডে দেখা মিলল অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যের পতাকার পাশাপাশি লাল-সবুজের পতাকাও!

এই শহরেই প্রথমবারের মতো সাফ শিরোপা জয়ের স্বপ্ন নিয়ে খেলতে এসেছেন সাবিনা খাতুন, মারিয়া মান্দারা। বাংলাদেশের মেয়েরা দুদিন স্থানীয় জুট মিলস মাঠে ও আজ সকালে মূল ভেন্যুতে অনুশীলন করেছে। মাঠে বসে গতকাল গ্রুপ প্রতিপক্ষ নেপাল ও ভুটানের ম্যাচ দেখেছে মেয়েরা। আগামীকাল বাংলাদেশ তাদের সাফ অভিযান শুরু করবে ভুটানের বিপক্ষে।

নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রাসাদ কৈরালার স্মৃতিময় শহর বিরাটনগর। ব্রিটিশ ভারতের বিহারে জন্ম নিলেও ১৯৫২ সালে কৈরালা বিরাটনগরের মেয়ে সুষমা কৈরালাকে বিয়ে করেন। সুষমা বিরাটনগর মহিলা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। এই শহরের প্রতিটি অলিগলিতে স্মৃতি জড়ানো রয়েছে নেপালের চারবারের প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা আন্তর্জাতিক পরিচিতির অভাব রয়েই গেছে এখানে। শ্রীলঙ্কায় শুরুতে হওয়ার কথা ছিল মেয়েদের সাফ। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় শ্রীলঙ্কান ফুটবল ফেডারেশন অনাগ্রহ দেখায় সাফের স্বাগতিক হতে। এরপরই প্রস্তাবটা লুফে নেয় নেপাল। আনফা (অল নেপাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) সিদ্ধান্ত নেয় ভূমিকম্পের শহর কাঠমান্ডুর বদলে এই বিরাটনগরেই সাফের আয়োজনের। কিন্তু যে শহরে ফুটবল নিয়ে তেমন উন্মাদনা নেই, সেখানে এমন বড় আয়োজনের সার্থকতার প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যায়। কাল স্বাগতিক নেপাল ৩-০ গোলে হারিয়েছে ভুটানকে। অথচ নিজেদের খেলা দেখতেও মাঠে আসেনি দর্শকেরা।

শহরের প্রতিটি রাস্তাঘাট খোঁড়া। যেন গ্রামের কাঁচা রাস্তায় ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি’ চলছে! শহরবাসী বলছে, খুব শিগগিরই শহরের রাস্তাঘাট নতুন করে সংস্কার করা হবে। বদলে যাবে চিরচেনা শহর। কিন্তু এখন যেন এখানে ধুলার বসতি গেড়েছে। তারপরও নিজেদের শহরে এমন আয়োজনে ভীষণ খুশি ট্যাক্সি চালক মঙ্গল শাহ, ‘আমি আর্জেন্টিনার ফুটবল সমর্থক। মেসি আমার প্রিয় খেলোয়াড়। এখানে ফুটবল হচ্ছে সেটা কমবেশি সবাই জানে। আমাদের শহরে এমন টুর্নামেন্ট এটাই প্রথম। আমরা খুব খুশি।’

কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমার ছাত্র ইয়াম ডিগো ফ্রাঙ্ক বলছিলেন, ‘এখানে মেয়েদের সাফ হচ্ছে ভেবেই আমরা গর্বিত। আনফার কাছে আমাদের চাওয়া এমন আরও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের।’
শহরটা যেমনই হোক না কেন, একটা ট্রফি জিতে বাংলাদেশের সবার হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে বিরাটনগর। সেই বিরাট স্বপ্নটা সত্যি করার দায়িত্ব যে সাবিনা, মারিয়াদের।