বাংলাদেশের ফুটবল লিগে যা কিছু দুর্দান্ত

দানিয়েল কলিন্দ্রেসের সঙ্গে গোল উদ্‌যাপন করছেন মার্কোস ভিনিসিয়ুস (জার্সি নম্বর ৯১) এবং আরামবাগের উইঙ্গার আরিফ ইসলাম। ফাইল ছবি
দানিয়েল কলিন্দ্রেসের সঙ্গে গোল উদ্‌যাপন করছেন মার্কোস ভিনিসিয়ুস (জার্সি নম্বর ৯১) এবং আরামবাগের উইঙ্গার আরিফ ইসলাম। ফাইল ছবি
>জাতীয় ও যুব দলের আন্তর্জাতিক ব্যস্ততার জন্য এক মাসের বিরতি চলছে প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে। ৬ এপ্রিল শুরু হবে পরের রাউন্ডের খেলা। এবারের লিগে আছে ফুটবলপ্রেমীদের আকৃষ্ট করার অনেক কিছুই

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের ম্যাচ গুলি কেন দেখতে যাবেন? রাতভর ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে বিশ্বসেরা তারকাদের কারিশমা দেখার পর বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল আপনার জন্য কি রেখেছে? অনেকেই ঠোঁট ওলটাতে পারেন! কীসের সঙ্গে কীসের তুলনা! কিন্তু বাজি ধরে বলা যায়, এবারের প্রিমিয়ার লিগ দেখতে যদি নিয়মিত মাঠে যান, তাহলে সে ধারণা একটু হলেও ভাঙতে বাধ্য। হ্যাঁ, ইউরোপীয় ফুটবলের সঙ্গে তুলনার হয়তো কিছুই নেই। জাঁকজমকও নেই, কিন্তু মাঠের ফুটবলটা কিন্তু নেহাতই মন্দ নয়। এই মৌসুমে আমাদের ফুটবল লিগ এমন অনেক কিছুই দিয়েছে, যা নিয়ে গর্বিত বোধ করা যায়। দেশের ফুটবলের অজস্র নেতিবাচক খবরের মধ্যে ফুটবল লিগে কমপক্ষে পাঁচটি ক্লাবের জোর শিরোপার লড়াই, দারুণ সব ব্যক্তিগত কারিকুরি, দৃষ্টি নন্দন গোল, উঁচু মানের বিদেশি ফুটবলার ইতিবাচক বার্তা হয়েই এসেছে। লিগের নয় রাউন্ড শেষে প্রিমিয়ার লিগের দারুণ দিকগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো...

গোল: মার্কোস ভিনিসিয়ুস (বসুন্ধরা কিংস বনাম শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র)

বলের ওপর নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ, দুর্দান্ত ড্রিবলিং করে এঁকে বেকে প্রতিপক্ষের ফাঁক গলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া, চোখ ধাঁধানো পাস আর দৃষ্টিনন্দন গোল। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের এমন সৌরভে বুঁদ থাকে পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশেও বেশ বড় একটা অংশ ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ভক্ত। নীলফামারীর শেখ কামাল স্টেডিয়ামে শেখ রাসেলের বিপক্ষে বসুন্ধরা কিংসের ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড মার্কোস ভিনিসিয়ুসের পায়ে দেখা গিয়েছিল তেমনই দুর্দান্ত এক গোল। বাম প্রান্ত থেকে মোহাম্মদ ইব্রাহিমের বাড়ানো বলে বক্সের কোনা থেকে লাফিয়ে উঠে বাইসাইকেল কিকে সেই গোলটি করেছিলেন ভিনিসিয়ুস। দুর্দান্ত গোল করে বড় ম্যাচ জিতিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কেমন ফুটবলার। লিগে সেটি তৃতীয় গোল ছিল তাঁর। এই গোলটিকেই লিগের সেরা গোল হিসেবে বিবেচনা করছেন দেশের অন্যতম সেরা কোচ মারুফুল হক।

অ্যাসিস্ট: আরিফ ইসলাম (আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ বনাম মোহামেডান স্পোর্টিং)

গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে দৌড়ান আরামবাগের উইঙ্গার আরিফ ইসলাম। সেকেন্ডে ৯.৯৬ মিটার বা ঘণ্টায় ৩৫.৮৫৬ কিলোমিটার দৌড়ানো কিন্তু হেলাফেলার বিষয় নয়। উইং দিয়ে দ্রুতগতিতে দৌড়ে গোল করাতে তাঁর জুড়ি নেই। ময়মনসিংহের রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে মোহামেডানের বিপক্ষে আরামবাগের ৪-১ গোলের জয়ের ম্যাচে দুর্দান্ত এক গোল করিয়েছিলেন। মাঝমাঠের অনেক নিচ থেকে বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্রুতগতিতে উঠে নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার ম্যাথেউ চিনেডুকে দিয়ে গোলটি করিয়েছিলেন আরিফ। গোলটি করানোর আগে আনুমানিক ৬৫ মিটারেরও বেশি দৌড়েছিলেন ২০ বছরের টগবগে এই তরুণ।

ফিটনেস বা শারীরিক সক্ষমতার উন্নতি
এবারের লিগে প্রায় প্রতিটি ম্যাচই হয়েছে দুর্দান্ত। খেলা দেখে কারও নাক সিটকানোর সুযোগ নেই। দুর্দান্ত সব গোলের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে গোল করানোর দক্ষতা। প্রতিটি দলই শেষ পর্যন্ত লড়াই করছে। এর পেছনে ফিটনেসের উন্নতি মূল ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন উপমহাদেশের একমাত্র উয়েফা ‘এ’ লাইসেন্সধারী কোচ মারুফুল হক। প্রতিটি দলই ফিটনেসেকে গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে করেন আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের কোচ, ‘এবারের লিগে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতিটি দলের ফিটনেসের মান ভালো। ফলে খুব ভালো খেলা হচ্ছে। বিভিন্ন ভেন্যুতে ভ্রমণ করার পরেও চোটের পরিমাণ কম। এটি খুবই ভালো লক্ষণ।’ এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক দল প্রাক-মৌসুম ক্যাম্প করেছে। দলগুলি হলো সাইফ স্পোর্টিং, বসুন্ধরা কিংস, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, শেখ জামাল, চট্টগ্রাম আবাহনী ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র।

খেলার লক্ষ্য স্পষ্ট
সাধারণত জয়ের লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নামে প্রতিটি দল। কোনো ম্যাচে ন্যূনতম এক পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়াও থাকে উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলাদেশের ক্লাবগুলো এক সময় মাঠে নামত কোনো লক্ষ্য ছাড়াই। খেলতে খেলতে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তাতেই সন্তুষ্টি। কিন্তু এবার সবারই লক্ষ্য পরিষ্কার মনে হয়েছে। দলটি জয়ের জন্য খেলছে না ড্রয়ের জন্য, এটা খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষাতেই ফুটে উঠছে। যা ভালো ফুটবলের জন্য খুব সহায়ক বলে মনে করেন মারুফুল, ‘জয় না ড্র, মাঠে নামার আগে লক্ষ্যটা পরিষ্কার থাকা উচিত। তাহলে সেভাবেই কৌশল সাজাতে পারেন কোচ। এবারের লিগে প্রতিটা দলের লক্ষ্য পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। যা ভালো ফুটবলের জন্য সহায়ক।’

ভালো মানের বিদেশি ফুটবলার
বহু বছর পর এবার বাংলাদেশের পেশাদার লিগে উড়িয়ে আনা হয়েছে বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলারকে। কোস্টারিকার জার্সিতে রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলা দানিয়েল কলিন্দ্রেসকে দলে ভিড়িয়েছে বসুন্ধরা কিংস। একই দলে আছে কিরগিজস্তান জাতীয় দলের মিডফিল্ডার বখতিয়ার দুশবেকভ, ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার মার্কোস ভিনিসিয়ুস ও স্পেন অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলে খেলা ডিফেন্ডার জর্জ গোটর। দলে হাই প্রোফাইল বিদেশি থাকায় বসুন্ধরার খেলা দেখার মজাই আলাদা। এ ছাড়া আগের তুলনায় অন্যান্য দলেও বিদেশি খেলোয়াড় কোটায় ভালো মানের খেলোয়াড় নেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জার্সিতে আলো ছড়াচ্ছেন আইভরি কোস্টের স্টাইকার বালো ফামুসা।
এশিয়ান কোটায় ক্লাবগুলো ভালো খেলোয়াড় নিয়েছে। কিরগিজস্তান জাতীয় দলের সহ অধিনায়ক ড্যানিয়েল ট্যাগো খেলছেন চট্টগ্রাম আবাহনীতে। আবাহনী লিমিটেডে খেলছেন আফগান জাতীয় দলের মাশি সাইগানি। কয়েকটি ক্লাবে আছেন উজবেকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের ভালো মানের ফুটবলার। এর মধ্যে আরামবাগের উজবেকিস্তান অনূর্ধ্ব-২৩ দলের সাবেক সেন্টারব্যাক ইকবাল বাবাখানোভ অন্যতম। এশিয়ান কোটার ব্যাপারটি থাকায় এবারের লিগে নিম্নমানের গা জোয়ারি আফ্রিকান ফুটবলারের সংখ্যা নেই বললেই চলে।