মেসির বিশ্বকাপ না জেতার জন্য আজীবন দায়ী থাকবেন হিগুয়েইন

মেসির কাছে সারা জীবন অপরাধী হয়ে থাকবেন হিগুয়েইন! ছবি : টুইটার
মেসির কাছে সারা জীবন অপরাধী হয়ে থাকবেন হিগুয়েইন! ছবি : টুইটার
>কাল আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার গঞ্জালো হিগুয়েইন। আর্জেন্টিনার ইতিহাসের ষষ্ঠ সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাস হয়তো তাকে মনে রাখবে তাঁর মিস করা গোলগুলোর জন্যই

চলছে ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল। মুখোমুখি আর্জেন্টিনা-জার্মানি। রূপকথার মতো ক্যারিয়ারে একমাত্র অপ্রাপ্তি বিশ্বকাপ না জেতা, সেই অপেক্ষা ঘোচাবেন মেসি, এই অপেক্ষায় আছেন আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা। কিন্তু ম্যাচের চার মিনিটের মাথায় গোল করার সুবর্ণ সুযোগ হারালেন স্ট্রাইকার গঞ্জালো হিগুয়েইন। বিশ মিনিটে নষ্ট করলেন গোলের আরেকটি সহজ সুযোগ। এই ব্যর্থতার চড়া মাশুল দিল আর্জেন্টিনা। শেষ বাঁশি বাজার পর জার্মানির হাতে বিশ্বকাপ।

পরের বছর কোপার ফাইনালে উঠল আর্জেন্টিনা। চিলির এস্তাদিও নাসিওনালেই মেসির হাতে শোভা পাবে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা। সেই শিরোপা জয়ের প্রহর গুনছেন বিশ্বের শতকোটি মেসি ভক্ত। নির্ধারিত সময়ের খেলা গোলশূন্য ব্যবধানে শেষ হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। স্নায়ুক্ষয়ী এই পরীক্ষায় বল আকাশে মারলেন গঞ্জালো হিগুয়েইন। সেই ভুলের সুযোগ নিয়ে কোপার শিরোপা জিতে নিল চিলি। মেসি আবারও ফিরলেন খালি হাতে।

ঠিক তার পরের বছর আবার কোপা ফাইনালে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা-চিলি। কোপা আমেরিকার শতবর্ষী আসরে ঘুচবে মেসির জাতীয় দলের হয়ে শিরোপা খরা, আশা করেছিলেন সকলে। কিন্তু এবারও হলো না। ম্যাচে শুরুর দিকে চিলির গোলরক্ষক ক্লদিও ব্রাভোকে একা পেয়েও ফাঁকা গোলপোস্টে বল পাঠাতে পারলেন না হিগুয়েইন। এই ম্যাচও গড়াল পেনাল্টিতে। নির্ধারিত সময়ে হিগুয়েইন গোল পেলে টাইব্রেকার নামের ভাগ্যপরীক্ষায় হেরে আর্জেন্টিনাকে হয়তো আরেকবার খালি হাতে ফিরতে হতো না, জাতীয় দলের হয়ে শিরোপা জিততে অপেক্ষার প্রহরও দীর্ঘায়িত হতো না মেসির।

এভাবেই ফুটবল বিধাতা মেসির দুর্ভাগ্যের সঙ্গে গঞ্জালো হিগুয়েইন নামটা জড়িয়ে দিয়েছেন একদম আষ্টেপৃষ্ঠে। এই তিনটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে আর্জেন্টিনার হারের জন্য অনেকেই দুষে থাকেন হিগুয়েইনের ব্যর্থতাকে। হিগুয়েইন যত দিন দলে থাকবেন, তত দিন দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিভা দেশের হয়ে কিছু জিতবেন না, এমনটা যেন সবাই এক রকম ভেবেই নিয়েছিলেন! হিগুয়েইন হয়তো নিজেও বুঝতেন। নিজের দেশের মানুষের তাঁর প্রতি কেমন ক্ষোভ, সেটা জানতেন।

কাল জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণাতেও প্রচ্ছন্নভাবে ফুটে উঠেছে হিগুয়েইনের সেই আক্ষেপ, ‘আর্জেন্টিনার জার্সিতে আমার সময় শেষ। গভীরভাবে ভেবে দেখলাম সময় শেষ হয়েছে। এখন (জাতীয় দলের) বাইরে থেকে সব দেখব, অনেকেই খুশি হবেন। লিওনেল স্কালোনির (আর্জেন্টিনা কোচ) সঙ্গে কথা বলে তাঁকে আমার অবস্থান বুঝিয়ে বলেছি। এখন জাতীয় দলে আমার থাকা না থাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাদ দিতে পারেন। টানা তিন ফাইনাল খেলেও শিরোপা জিততে না পারার জন্য আমাদের ব্যর্থ বলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ছিল বিশ্বকাপ। আমার কাছে ব্যর্থতার সংজ্ঞা অন্য কিছু। এখন ওরা (সমালোচক) নতুন খেলোয়াড়দের নিয়ে থাকুক। অনেক মানুষ সমর্থন দেওয়ার চেয়ে সমালোচনা করতেই বেশি পছন্দ করে। আমি মনে করি দেশের জার্সিতে নিজের যথাসাধ্য চেষ্টাই করেছি। অনেকে খুশি হবেন, আবার অনেকে নাও হতে পারেন, কিন্তু আমার সময় শেষ।’

জাতীয় দলের জার্সি গায়ে স্বয়ং ম্যারাডোনার গোলসংখ্যা হিগুয়েইনের চেয়ে মাত্র তিনটি বেশি। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মাত্র তিনজন খেলোয়াড় হ্যাটট্রিক করেছেন। এর মধ্যে একজন এই হিগুয়েইন। কিন্তু তাঁকে সবাই এসবের জন্য মনে রাখল কোথায়? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতায় সবাই যেমন সবকিছুর জন্য কেষ্টা ব্যাটাকেই দুষতেন, আর্জেন্টিনা দলের এই ‘কেষ্টা ব্যাটা’ ছিলেন যেন হিগুয়েইন!

জাতীয় দলের হয়ে খেলতে নেমে হয় অন্যের পাদপ্রদীপের আলোয় আড়াল হয়েছেন, নয় তো নিজের ব্যর্থতার মাশুল দিয়েছেন চরমভাবে। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে হিগুয়েইনের অভিষেকের দিনটার কথাই চিন্তা করুন। ২০১০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের বাঁচা-মরার ম্যাচে পেরুর বিপক্ষে আনকোরা হিগুয়েইনের ওপর আস্থা রেখেছিলেন ততকালীন কোচ ডিয়েগো ম্যারাডোনা। পাবলো আইমারের ডিফেন্সচেরা এক পাস ধরে অভিষেক-রাঙানো গোলও করেছিলেন তিনি। কিন্তু এরপরও সেই ম্যাচে হিগুয়েইনের ওপর থেকে আলো কেড়ে নিয়েছিলেন বোকা জুনিয়র্স স্ট্রাইকার মার্টিন পালের্মো। ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে পালের্মোর গোলটা না হলে যে বিশ্বকাপ খেলা হয় না আকাশি-সাদাদের!

গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে একটি গোলও করতে পারেননি হিগুয়েইন। দলের হয়ে ৩১ গোল করলেও সেসব গোল নয়, বরং হিগুয়েইন সম্ভবত সেই খেলোয়াড় হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় থাকবেন, যার জন্য লিওনেল মেসি বিশ্বকাপ জিততে পারেননি!