বর্ণবাদের ঘটনায় বোনুচ্চির ওপর খেপেছেন সবাই

উদ্‌যাপনের পর কিনকে সরিয়ে নিচ্ছেন বোনুচ্চি। ছবি: টুইটার
উদ্‌যাপনের পর কিনকে সরিয়ে নিচ্ছেন বোনুচ্চি। ছবি: টুইটার

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো না থাকায় মূল একাদশে সুযোগ পেয়েছিলেন ময়েস কিন। সেটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল ১৯ বছর বয়সী তরুণের জন্য। ক্যালিয়ারির দর্শকদের কাছ থেকে পুরো ম্যাচেই বর্ণবাদী দুয়ো শুনতে হয়েছে তাঁকে। প্রতিশোধও তুলে নিয়েছেন ময়েস। ৮৫ মিনিটে গোল করে ক্যালিয়ারি দর্শকদের সামনে উদ্‌যাপন করেন কিন। তারপর আরও তেড়ে আসে সমর্থকেরা। তাঁর দিকে ছুড়ে মারা হয় বোতল, পানি, কোক, এমনকি কলার খোসাও। দ্রুত তাঁকে জায়গা থেকে সরিয়ে নেন প্রতিপক্ষ গোলরক্ষক অ্যালিসিও ক্র্যাগনো। মাতুইদি, পিয়ানিচের সামনেই কেঁদে ফেলেন এই তরুণ তারকা।

এসব ক্ষেত্রে সতীর্থদের সমর্থন পান সবাই। কিন্তু ম্যাচ শেষে সাংবাদিকের সামনে এসে বোনুচ্চি করে বসেন উল্টো কাজ। সতীর্থ হিসেবে কিনকে সহায়তা কিংবা তাঁর পক্ষে কথা না বলে বোনুচ্চি দোষ চাপান কিনের ঘাড়েই। বোনুচ্চির বক্তব্য ছিল, ‘গোলের আগে থেকেই পুরো মাঠ থেকে বর্ণবাদী কথা আসছিল। আমার মনে হয়, এখানে কিন আর দর্শকদের দোষ পঞ্চাশ-পঞ্চাশ (সমান)। তার উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে উদ্‌যাপন করা। অন্য দলের সমর্থকদের সামনে এ রকম উদ্‌যাপন করলে কথা শুনতেই হবে।’ বোনুচ্চির এ রকম কথায় তেতে উঠেছে পুরো ফুটবল বিশ্ব। বোনুচ্চি পরোক্ষভাবে বর্ণবাদকে সমর্থন করছেন বলেও দাবি করেছে অনেকে।

ময়েস কিনের পোস্টে মারিও বালোতেল্লির মন্তব্য। সংগৃহীত
ময়েস কিনের পোস্টে মারিও বালোতেল্লির মন্তব্য। সংগৃহীত

কিনের অবস্থা খুব ভালোভাবেই বোঝেন মারিও বালোতেল্লি। দুই মিলানের হয়ে মাঠ কাঁপানো তারকাকে বারবার বর্ণবাদী আচরণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ইতালির জার্সি গায়ে দিয়েও ইতালিয়ানদের দুয়ো শুনতে হয়েছে তাঁকে। ম্যাচ শেষে যে উদ্‌যাপনের জন্য সমালোচনা শুনেছেন, সেটাই ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ করেছেন কিন। সঙ্গে লিখে দিয়েছেন, ‘বর্ণবাদের সেরা জবাব।’ কিনের সে পোস্টে বোনুচ্চির দিকে তোপ দাগিয়েছেন সুপার মারিও, ‘বোনুচ্চিকে বলো, ওর কপাল ভালো আমি ওখানে ছিলাম না। তোমার পক্ষে না দাঁড়িয়ে সে এসব বলছে? আমি পুরোপুরি হতভম্ব। আমি তোমার সঙ্গে আছি।’

গত ৬০ বছরে ইতালির হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে গোল করার রেকর্ড গড়েছেন কিন। এমন তারকার সঙ্গে ইতালিয়ানদের এমন আচরণের পর ইনস্টাগ্রামে তাঁকে সাপোর্ট জানিয়েছেন মাতুইদি, পগবা, ডগলাস কস্তারা। কিনের দেওয়া পোস্টের নিচে সবাই অভিবাদন জানাচ্ছেন তাঁকে। বলছেন শক্ত থাকতে। ইনস্টাগ্রামে বোনুচ্চিকে ধুয়ে দিয়েছেন রহিম স্টার্লিং, ‘ব্লেইম ইজ ৫০-৫০! খুব ভালো। চাইলে এখন হাসতেও পারো।’ মেম্ফিস ডিপে টুইটারে লিখেছেন, ‘মাঠে থাকা বোনুচ্চির কাজ দেখে আমি হতভম্ব। সে ইতালিয়ান এ হিসেবেও সম্মানটুকু পাওয়ার যোগ্য। আমরা চুপ থাকব না।’ আরেকটি টুইটে কিনের ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলা লাগছে, এর থেকে খারাপ আর কোনো কিছুই হতে পারে না।’

বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের টুইট। সংগৃহীত
বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের টুইট। সংগৃহীত

সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছেন আইভরি কোস্ট তারকা ইয়াইয়া তোরে। ফেসবুকে লিখেন, ‘গতকাল কিনের সঙ্গে যা হয়েছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সেটা (বোনুচ্চি যেটাকে কারণ বলেছেন) বর্ণবাদী আচরণের কারণ না। আমার প্রশ্ন ইতালিয়ান এফএ (ফুটবল ফেডারেশন) কাছে। মুখে মুখে “ইকুয়াল গেম” বলা লোকেরা কী করবে? উয়েফাই-বা কী পদক্ষেপ নেবে? এমন আচরণের পর আমি শুধু “দুঃখিত”–তে থেমে থাকতে চাই না।’

জুভেন্টাস অধিনায়ক জর্জিও কিয়েলিনিও দাঁড়িয়েছেন কিনের পক্ষে, ‘মাঠে বলার মতো কোনো অবস্থা ছিল না। সমর্থকদের আচরণে টেকা দায় ছিল সে সময়। আমি বলছি, কিনের কোনো দোষ ছিল না। সে ইতালিয়ান ফুটবলে আরও বড় ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাবে—এটাই আশা।’

ইনস্টাগ্রামে কেভিন প্রিন্স বোয়েটাং লিখেছেন ‘৫০-৫০!’ তার নিচে তিনটি মুখে আঙুল দেওয়া ইমোজি দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন সব। বরুসিয়া ডর্টমুন্ড তাদের টুইটারে বোনুচ্চিকে ড্রিবল করে পেছনে ফেলা রয়েসের ছবি দিয়ে ক্যাপশন হিসেবে দিয়েছে কান চেপে রাখা বানরের ইমোজি। এতেই যা দরকার, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে ক্লাবটি। টুইটারে একজন সমর্থক দোষ দিয়েছেন জুভেন্টাস বোর্ডেরই, ‘জুভেন্টাস বোর্ড ও খেলোয়াড়েরা রোনালদোর ধর্ষণ মামলায় যতটুকু সমর্থন দিয়েছে, তার অর্ধেকও কিনের ব্যাপারে দেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে না।’

বোনুচ্চির ক্ষমা চাওয়া পোস্ট। সংগৃহীত
বোনুচ্চির ক্ষমা চাওয়া পোস্ট। সংগৃহীত

এত কিছুর পর মুখ খুলেছেন বোনুচ্চি। ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে কিনের সঙ্গে এক ছবি দিয়ে লিখেন, ‘যত যা–ই হোক, বর্ণবাদকে “না” বলি।’ নিচে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য লিখেন, ‘২৪ ঘণ্টা আগে আমি যা বলেছিলাম, সে ব্যাপারে সবার ভাবনা দূর করতে চাই। ম্যাচ শেষে আমার কথাগুলো একটু বেশিই গুলিয়ে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে এত কথার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আমার পুরো জীবনে চেষ্টা করেছি বর্ণবাদের বিপক্ষে রুখে দাঁড়াতে। এবং আমি রুখে দাঁড়াব। আমার কথা কোনোভাবেই ভুল বোঝা না হোক।’

২৪ ঘণ্টা পর ক্ষমা চাইলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সমালোচনা থামাতে পারছেন না বোনুচ্চি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকেও দাবি করা হচ্ছে প্রথাগত ইতালিয়ান বর্ণবাদী লোকেদের একজন হিসেবে। উদ্‌যাপন নিয়ে অভিযোগ তোলা বোনুচ্চি যখন এক মৌসুমের জন্য এসি মিলানে খেলছিলেন, তখন জুভেন্টাসের বিপক্ষে গোল করে উদ্‌যাপন করেছিলেন। গোল করে জুভেন্টাস–সমর্থকদের তাতিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি ম্যাচের শুরুতে গোল করেও বুনো উদ্‌যাপন করেছেন বোনুচ্চি। তাই কিনের উদ্‌যাপনের দিকে আঙুল তোলা উল্টো কাল হয়েছে বোনুচ্চির।