সেই বিশ্বকাপ, এই বিশ্বকাপ

>রাশিয়া বিশ্বকাপের এখনো এক বছরও হয়নি, চলে এসেছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। দুটি বিশ্বকাপকে কীভাবে বরণ করে নিয়েছে বাংলাদেশ? পার্থক্যটা বোঝার ও েবাঝানোর চেষ্টা করেছেন রাজ শুভ নারায়ন চৌধুরী

বিশ্বকাপটার যেন ভীষণ মন খারাপ। সময়ের দরজায় ঠকঠক করে নিজের আগমনী ঘোষণা করে চলেছে, ব্যাট-বলের বিশ্বমাতানো লড়াই এই শুরু হলো বলে, কিন্তু সেটির তেমন উন্মাদনা কই! এই বছরখানেক আগেই বিশ্ব ঘুরে যাওয়া তার ‘বড় ভাই’ ফুটবল বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যে ক্রিকেট বিশ্বকাপটার অভিজ্ঞতার কিছুই মিলছে না।

রাশিয়ায় বিশ্বকাপটার স্মৃতি একটু ঝাপসা হয়তো হয়েছে, কিন্তু এখনো পুরোপুরি মিলিয়ে তো যায়নি। পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়নি এক বছর আগের ফুটবল–উন্মাদনার চিহ্নও। বেশি অনুসন্ধানের দরকার নেই, ঢাকার অলিগলিতে, বাড়ির ছাদে কোথাও না কোথাও এক বছরের রোদে-তাপে ঝড়ে-জলে জ্বলে থাকা কোনো শীর্ণ পতাকা চোখে পড়ারই কথা। আর্জেন্টিনা নয়তো ব্রাজিল, জার্মানি না হলে স্পেন, ফ্রান্স অথবা পর্তুগাল। এই রমজান মাসে দিনের বেলায় পাড়ার চায়ের দোকানগুলোতেই ঘুরে দেখুন, দর্শন মিলবে ‘আবরু রক্ষা’র দায়িত্ব পাওয়া আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকার।

শুধু কি পতাকা! ফুটবল বিশ্বকাপে শুধু দর্শকের ভূমিকায়ও সব সময় এত সরব বাংলাদেশ যে গত বছর বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিলের গ্লোবো টিভির তিন সাংবাদিক এসে ঘুরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। এই দেশটায় নেইমারদের নিয়ে, বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনার চিত্র ব্রাজিলে পৌঁছে দেবেন বলে। এই ব্রাজিলের সমর্থনে বাড়াবাড়ি করতে গিয়েই ‘কপাল পুড়েছে’ একজনের। পুরো বাড়িটাকে ব্রাজিলের পতাকার রঙে রাঙিয়েছিলেন, তাতে আলোচনায়ও এসেছিলেন। কিন্তু পরে অনুসন্ধানে জানা যায়, তাঁর যা বেতন আর যা পৈতৃক সম্পত্তি, তাতে এমন বাড়ি করার সাধ্য হওয়ার কথা নয়। ব্যস, তৎপর দুদক!

এই পতাকা টাঙানো, বাড়ি রাঙানো...ফুটবল বিশ্বকাপের আগমনী গান হয়ে সেসবের দৃশ্যমান হওয়ার শুরু তো হয়েছিল বিশ্বকাপের অনেক আগেই। কোথাও ১৫ দিন, কোথাও বা এক মাস। কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বকাপে? ব্যাট-বলের লড়াইটা শুরু হয়ে গেলে হয়তো উন্মাদনা বাড়বে, কিন্তু বিশ্বকাপের ১৫ দিন আগেও ঢাকার রাস্তায় বিশ্বকাপের ছাপ ছিল কই?

অথচ বাংলাদেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপেই উন্মাদনাটা বেশি হওয়ার কথা ছিল না? নেইমার-মেসি-রোনালদোরা তো দূর আকাশের তারা, তাঁদের দূর থেকে দেখাই যায় শুধু, তাঁরা আপন নন। কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বকাপে তো বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সিটাই থাকছে। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ—বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের খুব কাছের এই নামগুলোই আলো ছড়াবে বিশ্বকাপে। আশা অন্তত তা-ই।

চার বছর আগে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বিশ্বকাপে প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ, মাঝের চার বছরে ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাসের চেয়ে সাফল্যের হাসি অনেক বেশি। দ্বিপাক্ষিক সিরিজের বাইরে কখনো কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনাল না জেতার একটা আক্ষেপ ছিল, এর আগে ছয়বার ফাইনালে গিয়েও বেশির ভাগ সময়েই মিলেছে ‘ইশ-যদি’র আক্ষেপ। কিন্তু বিশ্বকাপের ঠিক আগে ‘রবার্ট ব্রুস’ বাংলাদেশ, সপ্তমবারের চেষ্টায় সফল! আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতেছে দল, বিশ্বকাপের প্রত্যাশার পারদ তাতে আরেকটু চড়েছে।

উন্মাদনাও কি একটু বেড়েছে? হয়তো। চায়ের আড্ডায়, ফেসবুকের স্ট্যাটাস-কমেন্টে তা টের পাওয়া যায়। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রতিটি জয়ে আনন্দ মিছিল, হয়তো কাজ ফেলে রেখেও টিএসসি-শাহবাগে বড় স্ক্রিনে বুঁদ হয়ে থাকা...অন্য সব বারের মতো দৃশ্যগুলোর দেখাও হয়তো মিলবে। তবে এক বছর আগের স্মৃতি জানিয়ে যায়, ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনা আর এই উন্মাদনায় কিছুটা ফারাক থাকবে।

কেন? সেটির বিশ্লেষণে থাকে একটা ‘টক শো’তে পরিণত হওয়ার ভয়। কিছুটা দায় এখানে আইসিসিরও! ২১১টি সদস্য নিয়ে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা যেখানে ‘গ্লোবালাইজেশনের’ প্রতীক, আইসিসির মোট সদস্যই তার অর্ধেক (১০৫); তার মধ্যে আবার ৯৩টিরই খোঁজখবর থাকে না, পূর্ণ সদস্য ১২টি দেশ নিয়েই যা মাতামাতি। এবার তা-ও নেই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপটাকে দশ দলের ‘ব্রাহ্মসমাজ’ করে রেখেছে আইসিসি। উদ্দেশ্য বাণিজ্যই হোক বা সত্যিকার অর্থেই ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়া, ২০২২ বিশ্বকাপ থেকেই যেখানে ৪৮ দলের বিশ্বকাপ করার চেষ্টায় ঘেমেনেয়ে একাকার ছিল ফিফা, ক্রিকেট বিশ্বকাপ ইতিহাসেই সব মিলিয়ে দেখেছে ২০টি মাত্র ভিন্ন দলকে।

খেলা দুটির মধ্যে কোনটির আবেদন বেশি, সে-ও অবশ্য এখানে একটা ব্যাপার। ফুটবল-ক্রিকেটে সে ‘যুদ্ধ’, এ নিয়ে কৌতুক তো অনাদিকাল ধরেই চলছে! ফুটবল যদি বলে তাঁর ম্যাচের সময় ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণেরও অর্ধেক, ক্রিকেট হাজির হয়ে যায় তার অনিশ্চয়তার স্লোগান নিয়ে। ১৯৩০ থেকেই বিশ্বকাপ নিয়ে হাজির হওয়া ফুটবল বয়সে বড় হওয়ার ‘দাদাগিরি’ও দেখাতে পারে, সে জায়গায় মাত্র ৪৪ বছর বয়সী ক্রিকেট বিশ্বকাপ বেশ পিছিয়ে। টাকার অঙ্কটাও ফুটবল বিশ্বকাপকেই এগিয়ে রাখে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে অর্থ পুরস্কার ছিল ৪০ কোটি ডলার, চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সই পেয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ; সেখানে এই কদিন আগে আইসিসি জানাল, ২০১৯ বিশ্বকাপে মোট অর্থ পুরস্কারই ১ কোটি ডলার!

দর্শক–উন্মাদনাতেও ক্রিকেট বিশ্বকাপের এত পিছিয়ে থাকার আরেকটা কারণ সম্ভবত খেলাটার ধরনই। ফুটবল ক্লাবভিত্তিক খেলা, ক্রিকেটটা শুরু থেকেই দেশে দেশে লড়াই। ফুটবলে চার বছর পরপর সব মহাদেশের সব দলের দেখা মেলে একই সমতলে, ক্রিকেটে তো সারা বছরই ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া বা ভারত-শ্রীলঙ্কা খেলে। অচেনাকে নতুন করে জানার রোমাঞ্চ আর এখানে কতটা?

গত বিশ্বকাপ থেকে এই বিশ্বকাপ পর্যন্ত শুধু অস্ট্রেলিয়া-ভারতের পরিসংখ্যানটাই দেখুন। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে মুখোমুখি হয়েছে ৩৭ বার, যেখানে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ অর্থাৎ ১৯৯৯ থেকে পরের বিশ্বকাপের মাঝে দুই দলের দেখা হয়েছিল ১৮ বার। প্রতিটি দলের ক্ষেত্রেই সংখ্যাটা বাড়ছে এমন জ্যামিতিক হারে। বিশ্বকাপে তাই যদি ‘আবার খেলছে ওরা!’ মনে হয় কারও, হয়তো দোষ দেওয়া যাবে না। প্রতিদিনই কাচ্চি খেতে থাকলে বিয়েবাড়ির কাচ্চিরও তো আর বিশেষত্ব থাকে না! ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক উত্তেজনার একমাত্র ইতিবাচক দিক হয়তো এই, আইসিসির টুর্নামেন্টে দুই দলের ম্যাচটার অন্য আবেদন থাকে।

আর প্রশ্ন যখন বাংলাদেশে ক্রিকেট–উন্মাদনার, সেটি ফুটবল বিশ্বকাপের মতো না হওয়ার একমাত্র কারণ হয়তো এই—এখানে বাংলাদেশ খেলে। ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় ভাগ হয় পুরো দেশ, পতাকা-ব্যানারে সেটি গর্বভরে জানানোর চেষ্টা থাকে, তর্কবিতর্কও তাই চলে হরদম। উন্মাদনা প্রকাশ পায় তাতে। কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বকাপে তো সব ছাপিয়ে একটাই ভাগ—বাংলাদেশ! অন্য দল নিয়ে, কোনো বিশেষ খেলোয়াড়কে নিয়ে আকর্ষণ থাকতে পারে, কিন্তু দিন শেষে সমর্থনের রংটা লাল-সবুজই।

পতাকার ছড়াছড়ি না থাকুক, বাড়িতে না লাগুক রং, উন্মাদনা না ছড়াক ততটা, বাংলাদেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপের তাই মূল আকর্ষণ এটিই। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলে।