বাংলাদেশের বিশ্বকাপ

>ফেবারিট ইংল্যান্ড। ভারত, অস্ট্রেলিয়ার কথাও বলছেন অনেকে। কিন্তু বাংলাদেশ কেন নয়? প্রশ্ন তুলেছেন তারেক মাহমুদ

ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জেতে না। ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ হলে জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া নয়তো ভারত। তবে এবার নাকি অন্য রকম হবে। সাবেক মহাতারকাদের কথা, বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড থাকবে ফেবারিটদের চূড়ায়। ভারত, অস্ট্রেলিয়ার কথাও কারও কারও মুখে শোনা যাচ্ছে। তবু ইংল্যান্ডের নামটাই আগে আসছে কারণ, খেলাটা হবে তাদের ঘরে।

শুধু ঘরের মাঠ বিশ্বকাপ জেতায় না। জেতালে বিশ্বকাপের ইতিহাস লেখা হতো অন্যভাবে। আগের ১১টি বিশ্বকাপে স্বাগতিক দল শিরোপা জিতেছে কেবল তিনবার। ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কা, ২০১১ সালে ভারত ও ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া। তিনবারই এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা ছিল যৌথভাবে স্বাগতিক। তার মানে স্বাগতিক বলে বিশ্বকাপ জেতার সূত্রটা দাঁড়াচ্ছেই না। বিশ্বকাপ জিততে আরও কিছু লাগে, আধুনিক ক্রিকেট যেটাকে বলে ‘এক্স ফ্যাক্টর’। এই এক্স ফ্যাক্টর একজন খেলোয়াড়ের মধ্যে যেমন থাকে, থাকতে হয় দলের মধ্যেও। সমস্যা হলো, এই জিনিস ঘটনা ঘটার আগে দেখা যায় না, বোঝাও যায় না। দশ দলের কোন দলের মধ্যে যে এক্স ফ্যাক্টর লুকিয়ে, সেটি বোঝা যাবে বিশ্বকাপ শেষে।

ঘরের মাঠ ব্যাপার নয়, এক্স ফ্যাক্টরও দেখা যায় না, তাহলে ইংল্যান্ড কেন সম্ভাবনার দৌড়ে এগিয়ে? কারণ দেড় বছর ধরে ওয়ানডে ক্রিকেটটাকে তারা ছেলেখেলা বানিয়ে রেখেছে। ছোট্ট একটি হিসাব দেওয়া যাক। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ৩৫টি ওয়ানডে খেলে ২৪টিতেই ইংল্যান্ড জিতেছে। হার মাত্র ৮টিতে। ঘরের মাঠের হিসাবটাও জেনে নিন। ১৩ ওয়ানডে, ১১ জয়, ১ হার। এই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে এসে খেলা ভুলে যাবে, এটি ভাবাই তো অস্বাভাবিক! বলতে পারেন বড় টুর্নামেন্টে বড় কিছু করার অভ্যাস তাদের কম। ২০১০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ছাড়া ইংল্যান্ডের সেই খাতাটির পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খালি। নাহ্, বিশ্বকাপ তাদের পেয়ালার চা নয়।

হতে পারে, কিন্তু বিশ্বকাপের আগে শুধু সম্ভাবনার কথাই তো বলা যায়। সেখানে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করে সবার আগে যে ইংল্যান্ডের নামটিই আসছে, তাতে নিশ্চয়ই কারও সন্দেহ নেই।

তা ইংল্যান্ড ছাড়া আর কে কে জিততে পারে ২০১৯ বিশ্বকাপ? ওই যে ভারত আর অস্ট্রেলিয়া! দুবার আর পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দুই দল। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সেও কাপে তাদের অধিকারই বেশি দেখা যাচ্ছে। এর বাইরে আর একটি দলও আছে, যারা হতে পারে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তারা কখনো বিশ্বকাপ জেতেনি। একবার শুধু শেষ আটে উঠেছে। সেটাই হজম করতে কষ্ট হয়েছে ক্রিকেট–বিশ্বের।

বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই কোন দলের কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ, বাংলাদেশ।

বুঝে গেছেন এবং চমকেও গিয়ে থাকতে পারেন। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে! কেন জিতবে না? ’৯৬–এর বিশ্বকাপ শ্রীলঙ্কা জিতবে, টুর্নামেন্টের আগে এটি বললেও নিশ্চয়ই চমকে যেতেন আপনি। কিন্তু শ্রীলঙ্কা তো জিতেছে! বিশ্বকাপের এবারের বাংলাদেশ দলেও কি সেই ছায়াটা দেখছেন না?

বাংলাদেশ দলের গত কয়েক বছরের উন্নতির গ্রাফটার দিকে তাকান। উত্তর হবে ‘হ্যাঁ।’ এবার অর্জুনা রানাতুঙ্গা, অরবিন্দ ডি সিলভা, সনাৎ জয়াসুরিয়া, রোশন মহানামা, অশঙ্কা গুরুসিনহাদের চেহারাগুলোতে মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহিমের মুখগুলো বসিয়ে নিন। খুব বেশি বেখাপ্পা নিশ্চয়ই লাগছে না।

বাংলাদেশের ‘রানাতুঙ্গা’ মাশরাফি কিন্তু আরও অনেক আগেই ড্রেসিংরুমে একটি বিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব ইংল্যান্ড ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতা। সেই বিশ্বাসের রেণু এত দিনে দলের সবাইকেই ছুঁয়ে গেছে একটু একটু করে। আনুষ্ঠানিক আলোচনায় তাঁদের কেউ সেটি মুখ ফুটে বলেন না। তাঁরা বলেন ম্যাচ ধরে ধরে এগোনোর কথা। বড়জোর বলবেন, সেমিফাইনালে যেতে চান। কিন্তু ঘরোয়া আড্ডা আর ব্যক্তিগত আলোচনায় মুখের ভাষাটা ভিন্ন, যার প্রভাব পড়তে দেখা যায় শরীরী ভাষায়ও।

বাংলাদেশ দল আয়ারল্যান্ড যাওয়ার কয়েক দিন আগের ঘটনা। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে বসে কথা হচ্ছিল দলের এক সিনিয়র ক্রিকেটারের সঙ্গে। তাঁর হিসাবে এবার বাংলাদেশের ফাইনাল খেলার সম্ভাবনা সুস্পষ্ট। এমনকি চ্যাম্পিয়ন হলেও নাকি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

সে রকমই যদি হয়, তাহলে দলটার সম্ভাব্য ‘এক্স ফ্যাক্টর’ তো আলোচনার স্বার্থেও খোঁজা যায়। একটা তো ওই ক্রিকেটারই খুঁজে দিলেন। অভিজ্ঞতা। বিশ্বকাপ খেলায় সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবার বাংলাদেশ দলই। চারজন আছেন তিন বিশ্বকাপ খেলা ক্রিকেটার, অন্য সব দল মিলিয়েই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে এ রকম খেলোয়াড় আছেন আর মাত্র দুজন। এরপর আসে তারুণ্যের শক্তি। সৌম্য সরকার রান–খরায় ভুগছিলেন। লিটন দাস নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রমাণ দিতে পারছিলেন না। মোসাদ্দেক হোসেনের ব্যাটিং-ঝলক শুধু ঘরোয়া ক্রিকেটেরই অলংকার হয়ে থেকে যাচ্ছিল। বিশ্বকাপ দলে এমন তিন ক্রিকেটারের উপস্থিতি নিয়ে একটা খচখচানি ছিল, যেটাকে এক আয়ারল্যান্ড ত্রিদেশীয় সিরিজেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ পেয়ে গেছে প্রথম ফাইনাল জয়ের স্বাদ, যে স্বাদ একবার পেলে বারবার পেতে ইচ্ছা করে।

বাংলাদেশের সামনে বিশ্বকাপ জেতার বেশ কয়েকটি কারণ তৈরি হয়ে আছে। এটা তাদের জন্য ‘পঞ্চপাণ্ডবে’র বিশ্বকাপ। মাশরাফি তো ননই; সাকিব, তামিম, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহদের মধ্যেও কি সবাই পরের বিশ্বকাপে দলে থাকবেন? বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তাঁরা অনেক দিয়েছেন। একটি বিশ্বকাপ দিলেই বা ক্ষতি কী! পরের বিশ্বকাপে যদি তাঁরা খেলেনও, নাহয় একটি বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ের অভিজ্ঞতা নিয়েই খেললেন। যে দেশে ক্রিকেটীয় উৎসব জাতীয় উৎসবকেও হার মানায়, সেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেরা অর্জনের সাক্ষী ‘পঞ্চপাণ্ডব’ না হতে পারলে তাদের প্রতি অন্যায়ই করে ফেলবে অদৃষ্ট।

বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিততে পারে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার জন্যও। দেশ ছাড়ার আগে নিজেই বলে গেছেন, বিশ্বকাপের পর খেলা চালিয়ে যাবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত এখনো না নিলেও এরপর অন্তত বিশ্বকাপটা আর খেলছেন না। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে শরীরটাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন বারবার। প্রতিবারই উঠে এসে আবারও রানআপে গেছেন বল হাতে। কিসের আশায়? মাশরাফি বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে একটা বড় কিছু নিয়ে যাবেন না! বাংলাদেশের ক্রিকেটের চেহারা বদলে দেওয়ার কারিগর বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছেন আজ। প্রথম শিরোপার পর বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফিটাও মাশরাফি উঁচিয়ে ধরলেই মানাবে বেশি। সবচেয়ে বড় কথা, তখন মনে হবে, সৃষ্টিকর্তা অন্যায় করেন না।

এটুকু পড়ে দুই রকম অনুভূতি হতে পারে পাঠকের। এক. বাংলাদেশ তো মনে হয় বিশ্বকাপ জিতেই গেল! অথবা, যিনি এসব লিখছেন, তিনি নিশ্চিত এই মাত্র পাগলাগারদ থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছেন। লেখকের কী করার আছে বলুন! বিশ্বকাপ শুরুর আগে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর তার এক্স ফ্যাক্টর খুঁজতে গেলে এ রকমই তো বলতে হবে। সেটি মানতে না পারলে আপনিই বরং খুঁজে নিন আপনার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। যার যার চ্যাম্পিয়ন তার তার কাছে থাকুক।

তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলে পরে কিন্তু বলবেন না, আপনি এটা আগেই জানতেন। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মতো রথী-মহারথী দলকে হারিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে বলতেও ভেতরে একটা ‘এক্স ফ্যাক্টর’ থাকতে হয়। সেটা আপনার আছে তো?