'ফ্রিথ' হওয়ার কী দরকার!

ভারতের ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয় ডেভিড ফ্রিথের মতো অনেককেই বাধ্য করেছিল নিজের কথা গিলতে।
ভারতের ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয় ডেভিড ফ্রিথের মতো অনেককেই বাধ্য করেছিল নিজের কথা গিলতে।
>

যে দল ইচ্ছা চ্যাম্পিয়ন হোক। ভবিষ্যদ্বাণী করার কোনো দরকার নেই। আমার ডেভিড ফ্রিথের মতো সাহস নেই। নিজের কথা নিজে গিলতে পারব না।

নিজের কথা নিজেকেই গিলতে হওয়া কথাটা নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। সেটিকে নিশ্চয়ই আক্ষরিক অর্থেও নেন না। আপনার ভালোমতোই জানা থাকার কথা, এটি উপমা হিসেবেই ব্যবহৃত। কোনো একটা ভবিষ্যদ্বাণী করলাম, সেটি মিলল না। এর অর্থই তো নিজের কথা নিজেকেই গিলতে হওয়া।

সাংবাদিক জীবনে অনেকবারই এই ভবিষ্যদ্বাণী নামের আগুন নিয়ে খেলতে হয়েছে। মূলত বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটের ক্রোড়পত্রের লেখাতেই। বেশ কবারই তা মিলে গেছে। অনেকে বাহবা দিয়েছে। নিজেও যে একটু আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছি, এটা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। আবার ভবিষ্যদ্বাণী মেলেনি, এমনও তো খুব কম হয়নি। কেউ তা নিয়ে খোঁচা দেয়নি বলে নীরবেই নিজের কথা নিজে গিলে ফেলেছি। কাকপক্ষীও টের পায়নি।

ডেভিড ফ্রিথের সেই সৌভাগ্য হয়নি। তাঁকে আক্ষরিক অর্থেই নিজের কথা গিলে ফেলতে হয়েছিল। কথা তো ‘বায়বীয়’ জিনিস, সেটি গেলার ব্যাপারটা দৃশ্যমান করে তোলাটা একটু কঠিনই। ফ্রিথকে সেই কঠিন কাজটাই করতে হয়েছিল। সাংবাদিকের সব কথা তো আর বাতাসে মিলিয়ে যায় না। পত্রিকায়–সাময়িকীতে মুদ্রিত আকারে থেকে যায়। ১৯৮৩ বিশ্বকাপের পর নিজের লেখার সেই মুদ্রিত রূপটা আক্ষরিক অর্থেই ‘খেয়ে’ ফেলতে হয়েছিল ফ্রিথকে।

‘কেন এবং কীভাবে’ ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে ডেভিড ফ্রিথের পরিচয়টা কি দিয়ে নেওয়া ভালো? সংক্ষেপে বলি, ডেভিড ফ্রিথ অনেক বছর ধরেই ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ। সাংবাদিকদের মধ্যে একমাত্র তাঁরই স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের বাড়িতে অবাধ যাতায়াতের অধিকার ছিল। দারুণ সব বই লিখেছেন। যার অনেকগুলোই পেয়ে গেছে ‘ক্রিকেট ক্ল্যাসিক’–এর মর্যাদা। ১৯৮৩ বিশ্বকাপের যে ঘটনার কথা বলছি, ফ্রিথ তখন ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত উইজডেন ক্রিকেট মান্থলির সম্পাদক। সেই বিশ্বকাপের আগে বিশেষ সংখ্যায় কোন দল কেমন করতে পারে—এ নিয়ে সম্পাদকের একটা লেখা ছিল। ফ্রিথ ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের কোনো সম্ভাবনা তো দেখেনইনি, বরং আগের দুটি বিশ্বকাপে পারফরম্যান্সের কথা মনে করিয়ে দিয়ে লিখেছিলেন, এবারও ভারত আগের দুটি বিশ্বকাপের মতো খেললে পরের বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের জন্য তাদের আইসিসির সহযোগী সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে কোয়ালিফাইং রাউন্ডে খেলতে বাধ্য করা উচিত।

কথাটা হয়তো আড়ালেই পড়ে যেত। পড়তে দেননি মান সিং। ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়ার পর আমেরিকাপ্রবাসী এই ভারতীয় সমর্থক চিঠি লিখে ফ্রিথকে সেটি মনে করিয়ে দেন। তাতেই দায়িত্ব শেষ মনে না করে জানিয়ে রাখেন ‘ছোট্ট’ একটা দাবিও—ফ্রিথের এখন উচিত, ‘নিজের কথা নিজেই খেয়ে ফেলা।’ ইংরেজিতে ‘ইট ইয়োর ওউন ওয়ার্ডস’ নামে যে প্রবাদটা আছে, সেটির আক্ষরিক প্রয়োগ দেখতে চাওয়া আরকি! কাজটা সহজ নয় বলে মান সিং একটা সুপরামর্শও দিয়েছিলেন। ভারতকে নিয়ে ওই কথাগুলো যে পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল, ফ্রিথ সেটি খাওয়ার সময় পছন্দমতো গরম বা ঠান্ডা পানীয় ব্যবহার করতে পারেন। উইজডেন ক্রিকেট মান্থলির পরের সংখ্যায় ‘লেটারস টু দ্য এডিটর’ বিভাগে সেই চিঠি ছাপা হলো। সঙ্গে ফ্রিথ বিশ্বকাপের আগে প্রকাশিত সাময়িকীর ওই পৃষ্ঠাটা খাচ্ছেন, এমন একটা ছবিও!

মান সিং নিশ্চয়ই মজা করেই প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। ডেভিড ফ্রিথও চাইলে চিঠিটার কথা চেপে যেতে পারতেন। সেটির বদলে আক্ষরিক অর্থেই তাঁর নিজের কথা নিজেই গিলে ফেলাটাও মজা করেই। তিনিও ভালোই জানতেন, এতে তাঁর ক্রিকেটজ্ঞান বা দূরদর্শিতা নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন উঠবে না। বিশ্বকাপের আগে ভারতকে সম্ভাব্য জয়ী বলে ঘোষণা করলে নির্ঘাত যেটি উঠে যেত। ওয়ানডে ক্রিকেটটা কীভাবে খেলতে হয়, ভারত তো তখন সেটিই জানত না। বিশ্বকাপ জিতে যাওয়ায় বাকি বিশ্বের মতো তারা নিজেরাও তাই কম বিস্মিত হয়নি। সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ও ফাইনালের নায়ক মহিন্দর অমরনাথের কথায় অনেক দিন পরও সেই বিস্ময়ের অনুরণন, ‘আমরা তো এর আগে বিশ্বকাপ খেলতে ইংল্যান্ড যেতাম লম্বা পায়ের ব্লন্ড মেয়েদের দেখতে।’ ওই বিশ্বকাপের আগে বিয়ে করা ভারতীয় ওপেনার কৃষ্ণামাচারি শ্রীকান্ত তো লন্ডনকে ‘স্টপ ওভার’ ধরে হানিমুন করবেন বলে আমেরিকার টিকিট কেটে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই টিকিটটা যে নষ্ট হবে, এটা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। এর আগের দুটি বিশ্বকাপে ভারত ম্যাচ জিতেছিল মাত্র একটি। সেটিও ইস্ট আফ্রিকার বিপক্ষে। যে ইস্ট আফ্রিকা দলটি গড়া হয়েছিল কেনিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া ও জাম্বিয়ার শৌখিন ক্রিকেটারদের নিয়ে। মূলত যা ছিল প্রবাসী গুজরাটিদের একটি দল। ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে পুরো ৬০ ওভার ব্যাটিং করে সুনীল গাভাস্কারের ৩৬ রানে অপরাজিত থাকাটাকেও সে সময় ওয়ানডেতে ভারতীয় দলের প্রতীকী চিত্র বলে ধরে নিতে পারেন।

২.
ডেভিড ফ্রিথকে উপলক্ষ করে এই পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটার একটাই কারণ—বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অভাবিত কিছুর উদাহরণ হিসেবে এখনো ১৯৮৩ সালের “কপিল’স ডেভিলস্’–ই বারবার ফিরে ফিরে আসে।” এর আগে–পরে এমন কিছু যে আর ঘটেনি। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া বা ১৯৯৬ বিশ্বকাপে অর্জুনা রানাতুঙ্গার শ্রীলঙ্কার শিরোপা জয়ে চমক ছিল, তবে তা বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেওয়ার মতো কিছু নয়। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ–পূর্ব সময়টা ভালো যাচ্ছিল না, তাই বলে তারা ক্রিকেটের বনেদি দলের মর্যাদা হারিয়ে ফেলেনি। রানাতুঙ্গার দল বিশ্বকাপ জয়ের বছরখানেক আগে থেকেই মৃদু স্বরে নিজেদের দাবি জানিয়ে আসছিল। প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারানো, শারজায় ত্রিদেশীয় চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার চোখে চোখ রেখে লড়াই...শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপ শুরু করেছিল ‘ডার্ক হর্স’ তকমাটা গায়ে নিয়েই। যত দূর মনে পড়ছে, প্রথম এই স্বীকৃতিটা দিয়েছিলেন কিউই গ্রেট স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। পরে অনেকেই সুর মেলান তাঁর সঙ্গে।

এত কথার একটাই সারমর্ম—বিশ্বকাপে একটা–দুটি আপসেট ঘটিয়ে ফেলতে পারে যেকোনো দলই, তবে হিসাবের একেবারে বাইরে থেকে কারও শিরোপা জিতে ফেলাটা একটু অসম্ভবই। একমাত্র ব্যতিক্রম ওই ১৯৮৩ বিশ্বকাপ। ‘ওয়ানডে খেলতে না জানা’ কপিল দেবের ভারতীয় দল।

সেই জয় ক্রিকেটে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য নিয়ে দেখা দেয়। এর আগ পর্যন্ত ‘অহেতুক একটা যন্ত্রণা’ বলে ভেবে আসা ওয়ানডেকে আপন করে নেয় ভারত। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনে ইংল্যান্ডের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’–এর অবসান ঘটিয়ে পরের বিশ্বকাপটা উপমহাদেশে চলে আসার মূলেও ওই সাফল্য। তাতে আরও বেশি হাওয়া লাগে উপমহাদেশে ওয়ানডের জনপ্রিয়তার পালে।

দুই যুগ পর আরেকটি বিশ্বকাপে ভারতের অভাবিত সাফল্যও একইভাবে ক্রিকেটের রং বদলে দেয়। আইপিএলের এমন দৈত্য হয়ে ওঠার পর এখন কল্পনা করাও কঠিন, টি–টোয়েন্টিকে ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসকেরা এর আগ পর্যন্ত কেমন বিতৃষ্ণার চোখে দেখতেন। ক্রিকেটকে বাণিজ্যে পরিণত করার কাজটা ভারতীয়দের দ্বারাই সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ওয়ানডেকে পছন্দ আর টি–টোয়েন্টিকে অপছন্দ করার মূলেও ছিল সেই বাণিজ্যিক বিবেচনাই। ক্রিকেট–বাণিজ্যের প্রাণভোমরা হলো টেলিভিশন। ওয়ানডে যেখানে এক ইনিংসেই ৫০টি বিজ্ঞাপন বিরতি উপহার দেয়, টি–টোয়েন্টি পুরো ম্যাচ মিলিয়েও এর চেয়ে ১০টি কম। টি–টোয়েন্টি তাই কেন ভালো লাগবে ভারতের? টি–টোয়েন্টি িবশ্বকাপের ধারণাটাও ভালো লাগেনি। প্রতিষ্ঠিত সব তারকাকে বিশ্রাম দিয়ে ভারত তাই তরুণ মহেন্দ্র সিং ধোনিকে অধিনায়ক বানিয়ে কচি–কাঁচাদের একটা দল পাঠিয়ে দিয়েছিল ২০০৭ সালে প্রথম টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ধোনির সেই দলই ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতে ফেলার পর চিরদিনের জন্যই বদলে গেল বিশ্ব ক্রিকেট। টি–টোয়েন্টি হয়ে গেল ক্রিকেটের নতুন ‘বাজওয়ার্ড’।

ভবিষ্যতের জন্য এমন তাৎপর্যবাহী হয়ে ওঠার কোনো সুযোগ নেই এই বিশ্বকাপের। সুযোগ নেই ১৯৮৩ বিশ্বকাপের মতো কোনো বিস্ময় উপহার দেওয়ারও। আচ্ছা, শুধু কথার খাতিরেই যদি প্রশ্নটা করি—এর কাছাকাছি কী হতে পারে? ভেবে ভেবে একটা উত্তরই খুঁজে পাচ্ছি। একমাত্র আফগানিস্তান চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলেই সেটির তুলনা হতে পারে ভারতের ওই অভাবিত জয়ের সঙ্গে। ধেৎ, এটি কি সম্ভব নাকি! লাইনটা লেখার পরই আবার ডেভিড ফ্রিথের কথা মনে পড়ে গেল।

থাক ভাই, যে দল ইচ্ছা চ্যাম্পিয়ন হোক। ভবিষ্যদ্বাণী করার কোনো দরকার নেই। আমার ডেভিড ফ্রিথের মতো সাহস নেই। নিজের কথা নিজে গিলতে পারব না। তার ওপর ফ্রিথের লেখাটা সুন্দর সাদা ফিনফিনে কাগজে ছাপা হয়েছিল, আমারটা ছাপা হচ্ছে নিউজপ্রিন্টে!