বিশ্বকাপের যত বিতর্ক...

খেলাধুলার কোন বড় টুর্নামেন্ট বিতর্ক ছাড়া হয়েছে? ক্রিকেট বিশ্বকাপও এর ব্যতিক্রম নয়। সেই ১৯৭৫ সাল থেকে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের ১১ আসরে খেলোয়াড়দের চোখধাঁধানো ক্রীড়াশৈলীর সঙ্গে বিতর্কিত ঘটনাও আছে। সেই ঘটনাগুলোই বিশ্বকাপ ইতিহাসের আলোচনার খোরাক। নস্টালজিয়ার অন্য রূপ। তাতে রোমাঞ্চ যেমন আছে, আছে পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারও। ইতিহাসের দিকে একটু চোখ ফেরালে কেমন হয়!

শেন ওয়ার্নের ডোপ কেলেঙ্কারি ঝড় তুলে ছিল ক্রিকেট দুনিয়া। ফাইল ছবি
শেন ওয়ার্নের ডোপ কেলেঙ্কারি ঝড় তুলে ছিল ক্রিকেট দুনিয়া। ফাইল ছবি



‘ডোপপাপী’ শেন ওয়ার্ন

২০০৩ বিশ্বকাপের কথা। টানা দুই বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন নিয়ে অস্ট্রেলীয় দল পা রাখল দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগ দিয়ে একটা দুঃসংবাদ কাঁপিয়ে দিল অস্ট্রেলীয় দলকে। ক্রিকেট দুনিয়া অবাক। ডোপ পাপে অভিযুক্ত হয়েছেন শেন ওয়ার্ন, খেলতে পারবেন না বিশ্বকাপ! শুধু তাই নয়, এক বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ বিশ্বসেরা এই লেগ স্পিনার। দলের মূল স্পিনারকে হারিয়ে অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের দুশ্চিন্তা। ওয়ার্নের বিকল্প হয় নাকি! ওয়ার্নের জায়গায় দলে আসলেন আনকোরা স্পিনার নাথান হরিজ। তবে দলটা অস্ট্রেলিয়া ছিল বলেই তবে ওয়ার্ন-ধাক্কা বেশি ভোগায়নি তাদের। সত্যিকার বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন পরিকল্পনার প্রয়োগ ঘটিয়ে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতেছিলেন ম্যাকগ্রা-গিলক্রিস্ট-পন্টিংরা।

বব উলমারের মৃত্যু আজও রহস্য। ফাইল ছবি
বব উলমারের মৃত্যু আজও রহস্য। ফাইল ছবি



বল উলমারের মৃত্যু

বল উলমার মারা গেছেন! ২০০৭ বিশ্বকাপে হাহাকার ফেলে দেওয়া এক ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই বিরাট ধাক্কা হয়ে এসেছিল ক্রিকেট দুনিয়ার জন্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সে বিশ্বকাপ এমনিতেই খারাপ কেটেছিল পাকিস্তানের। বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল প্রথম রাউন্ড থেকেই। তার ওপর উলমারের মৃত্যু রীতিমতো ঝড় বইয়ে দিয়েছিল তাদের ওপর। বলা হচ্ছিল, কতিপয় পাকিস্তানি খেলোয়াড়েরা ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে যুক্ত আছেন, এ কথা জেনে গিয়েছিলেন উলমার। ফলে ঠান্ডা মাথায় পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। যদিও এ দাবির সপক্ষে আজ পর্যন্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আইসিসি ঘোষণা দিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুবরণ করেছেন উলমার। কিন্তু তাও উলমারের মৃত্যু নিয়ে রহস্য উন্মোচিত হয়নি আজ পর্যন্ত।

ক্রিকেটের কলঙ্কজনক এক ছবি: ইডেন গার্ডেনের গ্যালারিতে দর্শকের লাগানো আগুন। ফাইল ছবি
ক্রিকেটের কলঙ্কজনক এক ছবি: ইডেন গার্ডেনের গ্যালারিতে দর্শকের লাগানো আগুন। ফাইল ছবি



কলকাতা-কেলেঙ্কারি

নিজেদের মাটিতে আরেকটি বিশ্বকাপ। শিরোপা জয়ই লক্ষ্য ছিল ভারতের। কিন্তু ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সেমিতেই থেমে গিয়েছিল মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের ভারতের দৌড়। অবশ্য সে ম্যাচে জয়-পরাজয় ছাপিয়ে কলঙ্কিত এক ঘটনায় বিমূঢ় হয়েছিল ক্রিকেট দুনিয়া। কলকাতার বিখ্যাত ইডেন গার্ডেনের গ্যালারিতে সেদিন লেগেছিল দর্শকদের অসহিষ্ণুতার আগুন!
সে ম্যাচে ভারতের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। সে সময় দুর্দান্ত ফর্মে থাকা শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার রমেশ কালুভিতারানা আর সনৎ জয়াসুরিয়াকে দ্রুতই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন জাভাগাল শ্রীনাথ। ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়া লঙ্কানদের পথ দেখান অরবিন্দ ডি সিলভা ও রোশান মহানামা। যদিও সংগ্রহটা ২৫১-এর বেশি নিতে পারেনি তারা। ইডেনের লাখো দর্শকের সামনে টেন্ডুলকার-আজহারউদ্দিন-সিঁধু-মাঞ্জরেকাররা ২৫১ রান খুব সহজেই টপকে যাবেন, এমন প্রত্যাশাই ছিল সকলের। ভারতের রান তাড়ার শুরুটা দারুণ হয়েছিল। শচীন টেন্ডুলকার উইকেটের চারদিকে মেরে লক্ষ্যটাকে সহজ বানিয়ে ফেলছিলেন। ভারতের এগিয়ে যাওয়ার এমন একটা সময় ‘লিটল মাস্টার’ ফিরলেন দলীয় ৯০ রানে, স্টাম্পড হয়ে। ভারতের ভাগ্য বিপর্যয়ের শুরুটা এখান থেকেই। ১ উইকেটে ৯৮ থেকে দলটা একপর্যায়ে পরিণত হয় ৮ উইকেটে ১২০-এ।
এমন ব্যাটিং পারফরম্যান্স হতেই পারে। কিন্তু ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেননি ইডেনের দর্শকেরা। শুরু হয় বোতল ছোঁড়া, গ্যালারিতে লাগিয়ে দেওয়া হয় আগুন। এমন একটা পরিস্থিতিতে খেলা চালিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ দেখেননি ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড। শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করেই ম্যাচ শেষ করে দেন লয়েড। ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে দর্শক হাঙ্গামার কবলে পড়া একমাত্র ম্যাচ এটিই।

অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই দলই ১৯৯৬ বিশ্বকাপে খেলতে যায়নি শ্রীলঙ্কায়। ফাইল ছবি
অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই দলই ১৯৯৬ বিশ্বকাপে খেলতে যায়নি শ্রীলঙ্কায়। ফাইল ছবি



অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ ‘বয়কট’
শ্রীলঙ্কায় তখন তামিল গেরিলাদের দৌরাত্ম্য। চলছে গৃহযুদ্ধ। এরই মধ্যে ১৯৯৬ বিশ্বকাপ ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজনের দায়িত্ব পায় তারা। তামিলদের সংগঠন এলটিটিই তখন শ্রীলঙ্কায় ভয়ংকর এক নাম। যত্রতত্র বোমা হামলায় প্রাণ যাচ্ছে অনেক নিরীহ মানুষের। এলটিটিইর হুমকি তখন জীবনাচারের অংশ হিসেবেই মেনে নিয়েছিল লঙ্কানরা। কিন্তু বিশ্বকাপ আয়োজনের কয়েক দিন আগে কলম্বোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এলটিটিই গেরিলারা আত্মঘাতী হামলা চালায়। অনেক মানুষ নিহত হয়। ফলে অনিশ্চয়তায় পড়ে যায় বিশ্বকাপের আয়োজন। অস্ট্রেলিয়ার মতো নাক উঁচু আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে খুঁতখুঁতে দেশ উপায় খুঁজতে থাকে শ্রীলঙ্কা না যাওয়া। শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোর ম্যাচ বয়কট করে ওয়াকওভার দেয় তারা। অস্ট্রেলিয়ার পথে হাঁটে ওয়েস্ট ইন্ডিজও। এতে অবশ্য সুবিধা হয় অর্জুনা রানাতুঙ্গার দলেরই। দুই ম্যাচ না খেলেই পূর্ণ ৪ পয়েন্ট পেয়ে যায় তারা। কেনিয়া আর জিম্বাবুয়ে অবশ্য শ্রীলঙ্কা আসতে আপত্তি জানায়নি। ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার গ্রুপের অন্য ম্যাচটি ছিল দিল্লিতে। লঙ্কানরা কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে আর ভারতের বিপক্ষে জিতে গ্রুপ সেরা হয়েই উঠে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। এরপর কোয়ার্টারে ইংল্যান্ড, সেমিতে ভারত আর ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জেতার ইতিহাস তো অন্য এক ঘটনাই।

১ বলে ২২ রান। বৃষ্টি আইনের কোপে পড়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার। ফাইল ছবি
১ বলে ২২ রান। বৃষ্টি আইনের কোপে পড়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার। ফাইল ছবি



দক্ষিণ আফ্রিকার পোড়া কপাল
বৃষ্টি বা অন্য কোনো কারণে ম্যাচ বিঘ্নিত হলে আধুনিক ক্রিকেটে ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ আর টনি লুইসের নাম উচ্চারিত হয়। তাঁদের হাত ধরেই পাল্টে গেছে আধুনিক ক্রিকেটে বৃষ্টি আইনের সংজ্ঞা। ডি/এল মেথডের আগে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। গড় রান রেট পদ্ধতি, সবচেয়ে ব্যয়বহুল ওভার, দ্বিতীয় ইনিংসের যে সময়টুকু খেলা বন্ধ থাকবে, প্রথম ইনিংসে ঠিক সে পরিমাণ ওভারের রান। অনেক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেও সবগুলোতেই বড় ফাঁক থেকে গিয়েছিল। যার অন্যায্য শিকার হতে হয়েছে কোনো একটা দলকে। এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত হয়ে আছে ১৯৯২ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচটি। বৃষ্টি নামার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রান। ১২ মিনিটের বৃষ্টি শেষে মোস্ট প্রোডাক্টিভ বা সবচেয়ে ব্যয়বহুল ওভারের হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন লক্ষ্য দাঁড়ায় ১ বলে ২১ রান! অথচ সেদিন যদি ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি থাকত, তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন টার্গেট হতো ১ বলে ৫ রান। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে জয় কিংবা টাইয়ের অন্তত সুযোগ থাকত। সে মুহূর্তে ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে জ্বল জ্বল করতে থাকা ১ বলে ২১ রানের ঘোষণার সেই ছবিটি ক্রিকেট ইতিহাসেরই অংশ হয়ে আছে।

কানে ইয়ারপিস লাগিয়ে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন হ্যানসি ক্রনিয়ে। ফাইল ছবি
কানে ইয়ারপিস লাগিয়ে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন হ্যানসি ক্রনিয়ে। ফাইল ছবি



ক্রনিয়ের ‘ইয়ারপিস’ বিতর্ক
১৯৯৯ বিশ্বকাপের কথা। দক্ষিণ আফ্রিকার হ্যান্সি ক্রনিয়ে-বব উলমার জুটি তখন ক্রিকেট বিশ্বকে একের পর এক চমক উপহার দিয়েই যাচ্ছেন। যুগান্তকারী সব ধ্যান ধারণার প্রয়োগ ঘটিয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন সবাইকে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে দেখা গেল, কানে ইয়ারপিস লাগিয়ে মাঠে ফিল্ডিং করতে নেমে পড়েছেন অধিনায়ক ক্রনিয়ে। ড্রেসিংরুমে থাকা কোচ উলমারের সঙ্গে খেলার মধ্যে পরামর্শ নেবেন, লক্ষ্য ছিল সেটিই। তবে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি স্ট্রাইকে থাকা ব্যাটসম্যান সৌরভ গাঙ্গুলীর আপত্তির মুখে। মাঠে থাকা আম্পায়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। আম্পায়াররা ক্রনিয়েকে অনুরোধ করেন ইয়ারপিস না ব্যবহার করার জন্য। যদিও তখন ইয়ারপিস ব্যবহার করাটা আইনবিরুদ্ধ ছিল না, তাও ক্রনিয়ে সেদিন আম্পায়ারদের কথা শুনে ইয়ারপিস খুলে রেখেছিলেন!