প্রত্যাশাটা চাপ নয় উৎসাহ হোক বাংলাদেশের

ক্রিকেটকে নিয়ে আমার বিদেশি বন্ধুরা তামাশা করে বলে, ব্রিটিশ কলোনির স্মৃতিচারণামূলক খেলা। কথা খুব একটা ভুল নয়। আফগানিস্তানকে বাদ দিলে ক্রিকেট এখনো মূলত ব্রিটিশ কলোনির সাবেক বাসিন্দারাই খেলে। আফগানিস্তানকে বাদ দিলাম এই কারণে যে তারা সেই অর্থে কখনোই সরাসরি ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ ছিল না, বেশ কয়েকবার ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের কাছে নতিস্বীকার করার পরও। 

তো বিদেশি বন্ধুদের কাছে ব্রিটিশ কলোনির রিইউনিয়ন মনে হলেও, বিশ্বকাপ ক্রিকেট আমাদের এই দিককার মানুষের প্রায় জীবন-মরণ ব্যাপার। খেলার ছন্দে এখানকার মানুষের রক্তে নাচন লাগে। জিতলে জীবন অর্থময় মনে হয়, হারলে এই জীবন ‘লইয়া কী করিবে’ সেটা খুঁজে পায় না কেউ কেউ। এর ভালো দিক হচ্ছে, হাজার অপ্রাপ্তির জীবনে এই সামান্য প্রাপ্তি তাকে সব অপ্রাপ্তি ভুলে থাকতে সাহায্য করে। খারাপ দিকটাও এটাই যে ক্রিকেট কখনো কখনো আফিমের মতো তাকে জীবনের নানা জরুরি বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

আপনাদের অনেকের মতোই আমিও আগ্রহ নিয়ে বসে আছি ক্রিকেট উন্মাদনায় মাতাল। যদিও এবার খেলা দেখাটা আমার কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জে পরিণত হবে। বিশ্বকাপের গোটা এক মাস আমার নতুন ছবি শনিবার বিকেল নিয়ে ঘুরব সিডনি, লন্ডন ও মিউনিখ। সিডনি ও লন্ডনে সমস্যা হবে না। বিপদে পড়ব মিউনিখের দিনগুলোতে। তবু ইরান-তুরান যেখানেই যাই, খেলা দেখা চলবে।

বাংলাদেশকে নিয়ে এবার প্রত্যাশার পারদ অনেক উঁচুতে, আঁচ করতে পারছি। অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতায় বাংলাদেশ কাগজে-কলমে শীর্ষস্থানীয় দলগুলোর একটি। বিশ্বাস করি, প্রত্যাশাকে চাপ হিসেবে না নিয়ে, উৎসাহ হিসেবে নিলে বাংলাদেশ ভালো কিছুই করবে।

শেষ করব খেলা দেখার স্পিরিট নিয়ে। নিজের দলকে সমর্থন করব, সেটা তো স্বাভাবিকই। অন্য দলকে নিয়ে স্লেজিংও হয়তো করব। কিন্তু খেলাকে ঘিরে যে জাতীয়তাবাদী উন্মত্ততা, সেটার লাগাম টানাটা বোধ হয় খুব জরুরি। বিশ্বকাপ আসলেই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সমর্থকদের মধ্যে অন্য দেশকে গালাগাল দেওয়ার যে অসুস্থ প্রবণতা, ঘৃণা চাষের যে অসুস্থ সংস্কৃতি, এটা খেলার জন্য ক্ষতিকর তো বটেই, আমাদের মনের স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। মনে রাখতে হবে, ভারত কিংবা পাকিস্তানকে গালাগাল দেওয়ার মাধ্যমে আপনি আপনার দেশকে বড় করছেন না, বরং ছোটই করছেন।

কেউ মনে করেন পাকিস্তানকে গাল দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পাস করতে পারি। কেউ মনে করেন ভারতকে গাল দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় ডিসটিংকশনসহ উত্তীর্ণ হওয়া যাবে। এটা একটা অসুস্থ সংস্কৃতি।

আপনি নির্দিষ্ট ইস্যুতে সমালোচনা করতেপারেন। ভারতের বাণিজ্যিক স্বার্থ কীভাবে ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফরম্যাট বদল করে ফেলল, সেটার সমালোচনা করতে পারেন, পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের ম্যাচ ফিক্সিংয়ের নিন্দা করতে পারেন, কিন্তু একটা দেশকে ঢালাওভাবে ট্রোল করতে পারেন না। কাউকে কাউকে দেখেছি পাকিস্তানের অতীত ভূমিকার জন্য পাকিস্তানের বিপক্ষে তাঁরা সমর্থন দেন। কাউকে দেখেছি ভারতের বর্তমান রাজনীতির জন্য ভারতের বিপক্ষে তাঁর সমর্থন। পক্ষ-বিপক্ষ সমর্থন বা কারও পরাজয় কামনা কোনোটা নিয়েই আমার আপত্তি নাই। আপত্তি লাগে যখন দেখি ঢালাও ভাবে কেউ একটা দেশ নিয়ে গালাগাল দেয়। মনে রাখতে হবে, আপনি যে কারণে ওই দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, সেটা ওই দেশের শাসকের নীতির বিরুদ্ধে আপনার অবস্থান। কিন্তু দেশ মানে তো শাসক না। শাসকতো একটা ক্ষুদ্রগোষ্ঠী। দেশ মানে মূলতই শোষিত। যে আপনার আমার মতোই টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। গাল দেওয়ার সময় এই মানুষগুলোর মুখ মনে রাখার দরকার! 

আর মনে রাখতে হবে খেলাটা শেষ পর্যন্ত উপভোগ করার বিষয়, যুদ্ধ করার নয়!

লেখক: চলচ্চিত্রনির্মাতা