এগিয়ে যাওয়ার দিন আসুক

রফিকুন নবী
রফিকুন নবী

ভারত-অস্ট্রেলিয়ার জমজমাট খেলাটি নিয়ে লিখব কি না ভাবছিলাম। না লেখার দিকেই ভাবনায় ভোট পড়ছিল বেশি। যদিও ক্রিকেটের দুই শক্তিধর দল দারুণ একটি খেলা খেলেছে, পুরোটা আমার দেখারও সুযোগ হয়েছে, তবু বারবার মনে হচ্ছিল এ নিয়ে লিখে কী হবে। আসলে ২০১৯ বিশ্বকাপ খেলা শুরুর আগে প্রথম আলোর গুণী দুই ঘনিষ্ঠজন সাজ্জাদ শরিফ ও আনিসুল হক যখন প্রায় নাছোড়ভাবে লেখার অনুরোধ করেছিলেন, তখন নিমরাজি ভাব নিয়ে বলেছিলাম, শুধু দেশের টিমের খেলাগুলোর ব্যাপারে চেষ্টা করব।

সেই কথাই মনে ঘুরপাক খাওয়ায় এই খেলা নিয়ে লেখার ইচ্ছেটি হচ্ছিল না। দুটি দলই ভাবেসাবে বিশ্বকাপটি জিতেই ফিরবে, এমনটা জানান দিয়েছে। তাদের প্রথম সাক্ষাতে মাঠে তা প্রমাণেরও চেষ্টা চালিয়েছে। সমানে সমান লড়াই। তবে একটিকে তো হারতেই হবে। তা শেষ পর্যন্ত হজম করতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়াকেই।

কোথায় যেন পড়েছিলাম এ রকম দলগুলোর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইকে বলে ‘হাই-ভোল্টেজ গেম’। ভোল্টেজ মানেই তো বিদ্যুতের ব্যাপার। আমার পাড়ায় এটি মাঝেমধ্যেই থাকা না–থাকার কাণ্ডটি ঘটে খেলা-খেলা মতন ভাবসাব নিয়ে। বেশ কয়েকটি খেলা চলাকালে এই খেলাটি কয়েক মিনিটের জন্য হলেও মাঝেমধ্যে ঘটেছে। তবে এই হাই–ভোল্টেজ খেলাটি পুরোটাই দেখতে পেরেছি বিনা বাধায়। তবু লিখব না–ই ভেবেছিলাম।

কিন্তু সকালের একটি ঘটনায় মত পাল্টালাম। বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম মেঘের অবস্থাটি দেখতে। বাইরে যাওয়ার উপায় হবে কি হবে না, তা পরখ করতে। পাশের রাস্তায় জটলা। পাঁচ-ছয়জনের একটি পাঁচমিশালি ভিড়। রিকশাচালক থেকে কলেজপড়ুয়া গার্মেন্টসের চাকুরে এমন। শুনলাম তাঁদের আলাপে ক্রিকেটই বিষয়।

একজন বলছিল বাংলাদেশ–ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার খেলার তুলনা করে। কথাটা এই রকম, ‘অস্ট্রেলিয়ার দশাটা হইল কইলাম আমাগো মতন। নিউজিল্যান্ডরে প্রায় ধইরা ফালাইছিল। কাঁপনি ছুটাইয়া দিছিল। অস্ট্রেলিয়াও তা–ই। শ্যাষের দিকে দম রাখতে পারে নাই।’

এ কথা শুনে একজন ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় ভরাডুবির কথা পাড়ল। প্রথমে বোলিং করার সিদ্ধান্তের জন্য ক্যাপ্টেনের সমালোচনার চেষ্টা করল। তা খণ্ডন করতে আরেকজন বলল, ‘আরে টসটাই হইল আসল ঘাপলা। লটারির মতন। জিতলে ব্যাট করব না বল নিব, ঠিক করতে হয় ক্যাপ্টেনরে। আমাগো ক্যাপ্টেন ঠিকটাই ধরছিল। ইংল্যান্ডের তো নিজের মাঠ, আবহাওয়াও নিজের। আর নিজেগো দর্শক তো আছেই। এইগুলা তাগো কামে দিছে।’

আরেকজন বলল অনেকটা এইভাবে, ‘হ, ঠিকই। মাঠটাও তো নিজেগো মতন কইরা বানাইন্যা। তয় ক্যাপ্টেনের ভুলভ্রান্তি হইতেই পারে। প্ল্যানের লগে ভাগ্যও লাগে। সবকিছু কোনো কোনো দিন খাপে খাপে মিলে না। ভাইবা দেখেন মাশরাফিরে কত কিছু নিয়া ভাবতে হয়। মোট নয়টা খেলা। তার মানে নয়টা দলের নিরানব্বইটা পিলিয়ারের কে কেমন, কেমনে সামাল দিতে হইব। কোন দলের কোন বেটা ব্যাটিংয়ে কীভাবে ছয়-চার মারার ঝাপটি মারে, কোন বোলার কেমনে বল লইয়া কী কারিগরি করে, কে কত কিলোমিটার বেগে বল ছাড়ে—এই রকমের কত কিছু নিয়া ভাবতে হয়।’

একজন যোগ করে, ‘ঠিকই। বেকায়দা রকমের ব্যাপার। ক্যাপ্টেনরে তো নিজেগো খেলোয়াড় নিয়াও ভাবতে হয়। এমনকি পিচে ঘাস আছে নাকি শুকনা খটখটা। মেঘ আছে কি না, ঠান্ডা আর বাতাসের জোর কেমন, তা দেইখা খেলার ধরন কী হইব তা–ও মাথায় রাখতে হয়। একটা মাথায় কত কাম! আবার নিজের খেলার কথাও মনে রাখতে হয়। আসলে অনেক দায়িত্ব। সহজ ব্যাপার না। এত কিছুতে দুই-একটা খেলায় এদিক-সেদিক তো হইতেই পারে।’

দম নিয়ে আবার শুরু করে, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার মতন বড় দলরে ধরছে না? ফাইন ধরা ধরছিল। সাকিবের মতন খেলা সবাই খেললে জিতনটা কোনো ব্যাপারই না। দেইখো শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তানরে ঠিকই কাইত কইরা ফালাইব। আর যদি পাকিস্তানরে ধরতে পারে। দলটার খারাপ দিনে, তাইলে তো কথাই নাই! আমাগো ঠেকায় কে? আর ভারত আর অস্ট্রেলিয়া তো কাপ জিতনের স্বপ্ন নিয়া চাপে আছে। বারে বারে জিতা পার্টিগো কাপ লওনটায় আসলে মজা নাই। এত দিন ধইরা য্যাতগুলো দলের খেলা-খেলির মজাটাই ট্যামা খাইয়া যাইব। একটারে না একটারে যদি বাইচান্স ধরন যায়, তাইলে পোয়াবারো।’

কলেজপড়ুয়া ছেলেটি বলল, ‘নিজেগো জিতার দিকটা ছাড়াও অন্যগো হারজিতের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। ধরেন, অস্ট্রেলিয়া বা ভারত পরপর কোনো দুই দলের কাছে হঠাৎ হাইরা গেল তখন তো আমাগো সমান পয়েন্ট হইব। ইংল্যান্ডের অবস্থাও তেমন হইব না, কে জানে! তয় আমাগো বাকি খেলাগুলায় ভালো করতে হইবই। গল্প আছে না—খরগোশরে দৌড়ে হারাইয়া দিছিল আস্তে হাঁটা কাছিম!’

তো এসব শুনে ভাবলাম যে লেখাটা লিখেই ফেলি ওদের কথাগুলোকে মুখ্য ভেবে। আসলে ক্রিকেট নিয়ে সবাই ভাবছে নিজের মতো করে।