আশা হরি ডুবল তরি

‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়’। সত্যিই আশা শুধু নয়, প্রায় নিশ্চিতই ছিলাম যে আমাদের দলটি ভারত-বধের মধ্য দিয়ে সেমিতে ওঠার পথটি সুগম করবে। কিন্তু আশা আশাই রয়ে গেল। গুলিটা ভারতের কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল আমাদের হাতে ‘হার’-এর ফলটি ধরিয়ে দিয়ে। মাত্র ২৮ রানের দূরত্বে থাকা ডাঙাটিতে আর পৌঁছানো গেল না। কাছাকাছি এসেও তরিটা ডুবলই।

অবশ্য তরির অবস্থাটিকে বেগতিক করার যে ঢেউয়ের বাড়িটা প্রথমেই আঘাত হেনেছিল, তা হলো টসে হার। তখনই প্রায় স্থির হয়ে গিয়েছিল ম্যাচের ভাগ্য। যদি ভারত ৩০০ রান পার করে ফেলে তো তা চেজ করা সহজ হবে না। এই দুশ্চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা যায়নি।

দ্বিতীয় ঢেউটির সর্বনেশে আঘাত রোহিত শর্মাকে তাঁর ৯ রানের মাথায় নিশ্চিত আউট হতে পারার সহজ ক্যাচটি তামিমের ধরতে না পারা। মনটা এখনো খচখচ করে ভেবে যে সেটি যদি তেমন না হতো, তবে শর্মার সেঞ্চুরিটা হতো না। আর তাহলে রাহুলেরও বড় রান করার সাহসটা বাড়ত না। দুজন মিলে ১৮০ রান করে নিজেদের দলের শক্ত খুঁটিটি পুঁতে দিলে বাকিদের কাজ জলবৎ হতে পারল টাইগারদের ৩১৫ রানের টার্গেট বেঁধে দিতে।

তো ক্যাচ ফেলে দিয়ে তামিমের মন ধসে গিয়ে যে মাঠে চুপসে যাওয়া, ভেবেছিলাম ব্যাটিংয়েও বোধ হয় দিনটা তাঁর পক্ষে থাকবে না। কিন্তু তা ভুল প্রমাণ করে দারুণ মনোবল নিয়ে ব্যাট করছিলেন। ভারতের মহা নামী বোলারদের অবলীলায় পেটাচ্ছিলেন স্বভাবসুলভতায়। কিন্তু শামির বলে আচমকা বোল্ড হলে তাঁর অগ্রযাত্রা ২২ রানে থেমে যায়। এই রানের অঙ্কটাও আকালের দিনে কম নয় মোটেও। যেমন সৌম্যের ৩৩ এবং সাব্বিরের ৩৬ অপর্যাপ্ত হলেও দর্শকদের কিছুক্ষণ আনন্দিত রাখতে পেরেছিল।

ধারণা হচ্ছিল, এ রকম টুকটাক স্কোরই-বা কম কিসে। যোগফলে গিয়ে নিশ্চয়ই কাজে দেবে। আর কেউ না কেউ যদি হঠাৎ দাঁড়িয়ে যান, ভারতকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয় বিপদের আঁচ দিয়ে; তবে তো এই অর্জনগুলোও কূল পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে।

যা-ই হোক, ভারতীয় ব্যাটিং পর্যায়টি রোহিত শর্মা-রাহুল পর্যন্তই অসাধারণ থাকতে পেরেছিল। বাকিটুকু যেনতেন না হলেও তেমন ভয় ধরানোর মতো ছিল না। আর তা হতে পারেনি আমাদের বোলারদের নিয়মিত গ্যাপে আউট করার কারণে। মোস্তাফিজ তো তাদের ভীতির কারণই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ভয় ধরানো বোলিং দিয়ে বিশ্বকাপে তাঁর ৫ উইকেট পাওয়ার মতো দুরূহ কাজটিও করে ফেলেছেন। তবে সাকিব, সৌম্য, রুবেল সহায়ক হয়েছিলেন প্রত্যেকে একটি করে উইকেট নিয়ে। ব্রেক থ্রুটা দিয়েছেন অবশ্য সৌম্য, খুঁটি গেড়ে বসা শর্মাকে ক্রিজছাড়া করে।

তৃতীয় মারাত্মক ঢেউটি আছড়ে পড়েছিল টাইগারদের তরিতে বিশ্বকাপের সফল নায়ক এবং দলের পরম ভরসা সাকিবের বিদায় নেওয়ায়। তাঁর চমৎকারিত্বে ভরা এগিয়ে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল হালটা যেভাবে শক্ত করে ধরেছেন, তাতে শর্মাকে ছাড়িয়ে যাবেন সেঞ্চুরি করে এবং দলের বাকি মাল্লা-মাঝিরা নিশ্চিন্তে তরিটিকে কূলে ভেড়াবেন নির্ঘাত।

সাকিবের আগে দলের সেরাদের অন্যতম মুশফিকের ২৪ রানে চলে যাওয়া এবং লিটনের প্রচেষ্টা ২২ রানে থেমে যাওয়া বিপদ ডেকে আনার শামিল হতে পেরেছিল।

মনটা ভেঙে গিয়েছিল তখনই। খেলা দেখার ইচ্ছাটা তখনই আধমরা হয়ে যাওয়ায় টিভির কাছ থেকে সরে গিয়ে ছবি আঁকায় মন দিয়েছিলাম। খেলার কথা ভুলে গিয়ে ক্যানভাসে যখন বেশ মনোযোগী হয়ে উঠছি, তখনই হঠাৎ আমার গাড়ির চালক এসে আবার খেলার ভাবনাটি উসকে দিয়ে বলল, ‘খেলা তো দারুণ জইমা গেছে। দেখবেন না? জিতনের কাছাকাছি আইসা গেছে।’

ওর কথায় আশান্বিত হয়ে আবার টিভির সামনে বসলাম এবং সত্যিই তা-ই। দেখলাম, ৬ ও ৭ নম্বর ব্যাটসম্যান সাব্বির ও সাইফউদ্দিন দারুণ জমিয়ে ফেলেছেন খেলা। দেখলাম কোহলির চিন্তান্বিত চেহারা। কিন্তু তা আর রইল না। সাব্বিরকে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে দিয়েই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন কোহলিরা এই ভেবে যে বাকিরা তো দুধভাত। তাঁরা তো ব্যাটিংয়ের ব্যাপারে কাউন্টেড ফ্যাক্টর না।

তা-ই হলো। শুধু ৫১ রানের অসাধারণ অর্জন নিয়ে সাইফউদ্দিন অপরাজিত থাকলেন দলের পরাজয়ের দিনের শেষ সাক্ষী হয়ে। সেমিফাইনালে যাওয়ার মরীচিকাময় আশাটাকে মুছে দিয়ে এখন শুধু বাকি একটি খেলায় জয়ের ভাবনাটি রয়ে গেল। তা হলো পাকিস্তানকে শেষ খেলায় হারাতে পারার সম্ভাব্যতা।

তাতে আর কী যায়-আসবে। তবে জয়ী হলে হয়তো আত্মপ্রসাদ বাড়বে, কিন্তু বিশ্বকাপের ব্যাপারে কোনো কাজেই আসবে না। জিতলে ৯ পয়েন্ট, নইলে ৭ পয়েন্ট পকেটস্থ করে ঘরে ফিরতে হবে। আর আমরা ভাঙা মন নিয়ে অন্যদের জয়-পরাজয় দেখব। কাপটি জয় করতে দেখব!