আর কবে শিখবে বাংলাদেশ?

মুশফিকুর রহিম ছাড়া সিনিয়রদের কেউ দাঁড়াতে পারেননি। ছবি: প্রথম আলো
মুশফিকুর রহিম ছাড়া সিনিয়রদের কেউ দাঁড়াতে পারেননি। ছবি: প্রথম আলো

নতুন কোনো কথা তো এটা নয়ই, বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মুখে শুনতে শুনতে এখন বরং একঘেয়ে হয়ে গেছে ভীষণ। ‘এই সিরিজ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, যা পরের সিরিজে কাজ লাগবে’—বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারের মুখে এটা শুনলে এখন উল্টো বিরক্তিই লাগার কথা এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। যে শিক্ষা টেস্ট ক্রিকেটে ১৯ বছর পথচলার পরও হয়নি, সেটা আর কবে হবে! ‘শিখছি’ বলে বলে মুমিনুল-মুশফিকরা আর কত দিন পার করবেন?

কলকাতার ইডেনে আড়াই দিনের কম সময় গোলাপি টেস্টটা হেরে যাওয়ার পর অধিনায়ক মুমিনুল যখন সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেন, ‘এই সিরিজ থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। এই বোলারদের বিপক্ষে কীভাবে খেলবেন, এই মানের বোলারদের সামলাতে কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন। এই শিক্ষা পরের সিরিজে অনেক বেশি কাজে দেবে,’ পুরো কথাটাই কেমন হাস্যকর শোনায়! অভিজ্ঞতা তো মুমিনুলেরও কম হলো না। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁরও তো বছর ছয়েক হয়ে গেছে। আর মুশফিক-মাহমুদউল্লাহদের তো ক্যারিয়ারের সায়াহ্নই চলে এসেছে বলা যায়। এখনো শিখছেন!

মুমিনুল অবশ্য আপত্তি করতে পারেন। এই সিরিজ খুব বাজে খেলেছেন। কলকাতায় জোড়া শূন্য, তার আগে ইন্দোরে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৪৪। কিন্তু তারপরও তো এই বাংলাদেশের দলে বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের ব্যাটিং গড়ই সবচেয়ে ভালো। ৪১.৪৭ গড় নিয়ে ভারত সফর শুরু করেছিলেন, শেষ করেছেন ৩৯.৬৫ গড় নিয়ে এবং এটাই বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে যেকোনো ব্যাটসম্যানের তুলনায় সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং গড়।

>

যে শিক্ষা টেস্ট ক্রিকেটে ১৯ বছর পথচলার পরও হয়নি, সেটা আর কবে হবে! ‘শিখছি’ বলে বলে মুমিনুল-মুশফিকরা আর কত দিন পার করবেন?

একটু বিস্মিত হওয়ার মতোই। একটা দেশের প্রায় দুই দশক টেস্ট ক্রিকেটে পদচারণ, তারপরও ৪০-এর ওপর ব্যাটিং গড় নেই কোনো ব্যাটসম্যানের। টেস্ট ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যানের জন্য ৩৯ গড় হয়তো একেবারে খারাপ নয়। এই যেমন ইংল্যান্ডের বেন স্টোকসেরই ব্যাটিং গড় ৩৬.০৩, দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি ককের গড় ৩৮.১১। দুজনেই চল্লিশের ওপর টেস্ট খেলেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য, স্টোকস শুধু ব্যাটসম্যান নন, অলরাউন্ডার এবং তাঁর দলে জো রুটের মতো সমকালীন ক্রিকেটের অন্যতম সেরা একজন ব্যাটসম্যান আছেন। যেমন ডি ককের দলে আছেন ফাফ ডু প্লেসির মতো অভিজ্ঞ ও এইডেন মার্করামের মতো প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ। দুজনেরই গড় চল্লিশের ওপরে।

আমাদের দলে একজন বিরাট কোহলি নেই, একজন স্টিভ স্মিথ, জো রুট বা কেন উইলিয়ামসন নেই। টেস্ট ক্রিকেটের প্রতাপশালী দল হতে হলে এ রকম একজন ব্যাটসম্যান একটা দলে থাকা লাগে। সেই আশা না হয় বাদই থাকল। একজন রোহিত শর্মা, ডেভিড ওয়ার্নার, শিখর ধাওয়ান, রস টেলর মানের ব্যাটসম্যানও কি আছে? কিংবা এই ১৯ বছরে সে রকম কাউকে পেয়েছি আমরা?

তর্কযোগ্যভাবে কিংবা হয়তো তর্কাতীতভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা ব্যাটসম্যান বলা হয় মুশফিকুর রহিমকে। কিন্তু ৬৯ টেস্ট আর ১২৯ ইনিংস পরও তাঁর ব্যাটিং গড় ৩৫.০৮, সেঞ্চুরি মাত্র ৬টি, হাফ সেঞ্চুরি ২১টি। অর্থাৎ ১২৯ বার ব্যাট করতে নেমে সব মিলিয়ে মাত্র ২৭ বার টেস্টে ৫০ পেরিয়েছেন মুশফিক। এটা যদি একটা দেশের ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানের পরিসংখ্যান হয়, তাহলে সেই দেশকে নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে কতটা আশাবাদী হওয়া যায়?

অভিজ্ঞতার দিক থেকে বাংলাদেশ অন্য বেশির ভাগ টেস্ট দলের বর্তমান স্কোয়াডের চেয়ে এগিয়ে। মুশফিক, সাকিব, তামিম, মাহমুদউল্লাহ, ইমরুল কায়েস—এঁরা প্রায় সবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ বছরের বেশি কাটিয়েছেন। কিন্তু কায়েস ছাড়া বাকি সবার টেস্ট ব্যাটিং গড় ত্রিশের ঘরে, কায়েসের তো মাত্র ২৪.২৮।

হ্যাঁ, পাল্টা যুক্তি আসতে পারে, গড় তো আর ধ্রুব কোনো জিনিস নয়, এটা কমে-বাড়ে। সুতরাং গড় কম মানেই যে ব্যাটসম্যান ভালো নন, সেটা ঠিক নয়। সত্যি কথা। তবে ব্যাটসম্যান যত পরিণত হন, তাঁর শেখার ছাপটা তত বেশি স্পষ্ট হয় খেলায়। আর সেই অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয় তাঁর পারফরম্যান্স, পরিসংখ্যানে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে সেই পারফরম্যান্স কি অভিজ্ঞতার তুলনায় সামঞ্জস্যপূর্ণ?

একটা ছোট পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। বিভিন্ন দেশের বর্তমান (গত দুই বছরের মধ্যে খেলেছেন) টেস্ট দলে অন্তত ১০টি ইনিংস খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ভারতে চল্লিশের ওপর গড় ৮ জনের, নিউজিল্যান্ডে ৭ জনের, অস্ট্রেলিয়ায় ৬ জনের। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কায় চল্লিশের ওপর গড় আছে একাধিক ব্যাটসম্যানের। নেই শুধু বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের। টেস্টে এই তিনটা দলের অবস্থাই এই মুহূর্তে শোচনীয়। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়েরা তো অনেক দিন ধরেই টেস্ট ক্রিকেট আর গুরুত্ব দিয়ে খেলেন না, জিম্বাবুয়ে তো নানা রকম অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। এমনকি নবাগত আফগানিস্তানও ভালো করছে এই তিন দলের চেয়ে।

এখন মুশফিক-মুমিনুলদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা, তাঁরা কি টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-জিম্বাবুয়ের কাতারেই থাকতে চান, নাকি ভারত-অস্ট্রেলিয়ার পর্যায়ে যেতে চান!