'অনিরাপদ সড়ক' কেড়ে নিয়েছিল দুই দ্রুততম মানবকে

দেশের ইতিহাসের সেরা দুই অ্যাথলেট। দুজনেই প্রাণ হারিয়েছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায়। ছবি: সংগৃহীত
দেশের ইতিহাসের সেরা দুই অ্যাথলেট। দুজনেই প্রাণ হারিয়েছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায়। ছবি: সংগৃহীত
>

অনিরাপদ সড়ক এ দেশের দুঃখ। ক্রীড়াঙ্গনেরও হাহাকার। সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল দুই ইতিহাস-সেরা স্প্রিন্টার শাহ আলম ও মাহবুব আলমকে। এসএ গেমসের ১৩তম আসরের শুরুর দিনে এই দুই কীর্তিমানকে শ্রদ্ধা...

এসএ গেমস এলেই শাহ আলমের কথা খুব মনে হয়। সেটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ সাফল্য বুভুক্ষু বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে একাধিকবার জয়ের আনন্দে আনন্দিত করেছিলেন তিনি। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে পরপর দুবার রেকর্ড গড়ে সোনা জিতে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হয়েছিলেন আলম। ইতিহাস-সেরা এই অ্যাথলেটকে আমরা হারিয়েছি বড় অবেলায়। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য অনিরাপদ সড়কের বলি হয়েছিলেন এই কীর্তিমান।

মাত্র ২৮ বছর বয়সেই এ দেশের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অথচ, দেশকে অনেক কিছুই দেওয়ার বাকি ছিল তাঁর। ১৯৯০ সালের ২৯ মে নিজের গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী থেকে মোটরসাইকেলে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। কিন্তু পথে পাবনার কাশিনাথপুরে ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান তিনি। সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। কয়েক দিনের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলেন। গাংনীর সাহেবনগর গ্রামে বাবা-মা আর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ফিরছিলেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে কেড়ে নেয় তাঁকে।

শাহ আলম নামটা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৮৪ সালের কাঠমান্ডু সাফ গেমসে। সেবার সাইদুর রহমান ডন, আফতাব মোল্লা, মুজিবুর রহমান মল্লিকের সঙ্গে দল বেঁধে শাহ আলম জিতেছিলেন ১০০ মিটার রিলের সোনার পদক। সেবারই ফটো ফিনিশে ১০০ মিটার স্প্রিন্টের সোনার পদকটি হাতছাড়া হয়। আফতাব মোল্লার দুর্ভাগ্য, তিনি ভারতের স্প্রিন্টার আদিল সুমনওয়ালার কাছে সোনার পদক হারান। সেই অপূর্ণতাকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন শাহ আলম। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে শাহ আলম আদিল সুমনওয়ালার গড়া ১০.৯০ সেকেন্ডের রেকর্ডটি ভেঙে (১০.৮০) দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ‘দ্রুততম মানব’ হয়ে দেশকে গর্বিত করেন। এখানেই তিনি থেমে যাননি। দুই বছর পর ১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসে নিজের রেকর্ড ভেঙে ১০.৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি টানা দ্বিতীয়বারের মতো ১০০ মিটার স্প্রিন্টের মুকুট নিজের করে নেন। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে স্প্রিন্টে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শাহ আলমের মাধ্যমেই।

১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে ওই মুকুটটা ধরে রাখতে পারেননি শাহ আলম। সেবার কোনো মতে ব্রোঞ্জ জেতেন। শাহ আলমের জন্য সেটি ছিল নিদারুণ ব্যর্থতাই। দ্রুততম মানবের খেতাব হারিয়ে বিচলিত আলম নিজেকে ফিরে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৯০ সালের ২৯ মে তিনি ফিরছিলেন সে বছরই বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি শুরু করতে। ইসলামাবাদে সোনার পদক হারানো শাহ আলম এশিয়ান গেমসকেই নিজের ফেরার মঞ্চ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি আর হয়নি। দুর্ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন কিনা, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি কখনোই। তাঁর মৃতদেহ শনাক্তই হয়েছিল অনেক পরে। তবে এটা ঠিক, শাহ আলমের মৃত্যু হতবিহ্বল করে দিয়েছিল গোটা দেশকে।

অনিরাপদ সড়ক শাহ আলমের মতোই কেড়ে নিয়েছিল আরেক দৌড়বিদকে। বাংলাদেশের খেলার ইতিহাস লিখতে গেলে শাহ আলমের মতোই মনে করতে হবে তাঁর কথা—মাহবুব আলম। ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ছিল তাঁর। ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) সাফ গেমসে বলা নেই, কওয়া নেই ঝড়ের বেগে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে ফেলেছিলেন মাহবুব। শাহ আলমের একজন যোগ্য উত্তরসূরিকেই যেন সেদিন খুঁজে পেয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালে ফটোফিনিশে ২০০ মিটারের সোনা হাতছাড়া হয় মাহবুবের। কিন্তু ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। কুমিল্লা থেকে মাইক্রোবাসে করে ঢাকা ফেরার পথে কাঁচপুরের কাছে ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় মাহবুবের মাইক্রোবাসের।

এস এ গেমসের আরও একটি আসরের শুরু আজ থেকে। এমন দিনগুলোতে শাহ আলম কিংবা মাহবুব আলমরা আসেন বড় দীর্ঘশ্বাস হয়েই। আরও একজন শাহ আলম অথবা মাহবুবকে তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতা সেই দীর্ঘশ্বাসকে আরও প্রলম্বিত করে। এস এ গেমসের অ্যাথলেটিকসে ১৪ বছর ধরে সোনা জিততে না পারা বাংলাদেশ একজন শাহ আলম অথবা মাহবুবকে খুঁজে বেড়ায় খুব করেই।