নেইমার এবারও মাটিতে, তবে প্রার্থনায়

লাইপজিগের বিপক্ষে দারুণ আলো ছড়িয়েছেন নেইমারছবি: এএফপি

কান্না তাঁর খুব সহজেই আসে। আবেগটা তাঁর একটু বেশি। আনন্দ হোক বা বেদনা, হাসি অথবা কান্না—সেটির প্রকাশে নেইমার কখনো কুণ্ঠিত হন না। সেই নেইমার তাঁর ‘চ্যালেঞ্জে’ জয়ের এত কাছে এসে আবেগে ভেসে যাবেন না, তা তো আর হয় না!
নেইমার আবেগে ভাসলেন। অতীত স্মৃতিতে ফিরে বর্তমানকে দেখে কাঁদলেন। তবে এবারের কান্নায় মিশে আছে আনন্দ, এবারের কান্না ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনায়। যে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর স্বপ্ন নিয়ে ২০১৭ সালে মেসির বার্সেলোনা ছেড়ে এসেছিলেন পিএসজিতে, সে স্বপ্ন পূরণের আর ৯০ মিনিট দূরে দাঁড়িয়ে নেইমার। যে স্বপ্ন পূরণে আগের দুই মৌসুমে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেরসিক চোট। সব বাধা পেরিয়ে ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে ওঠার আনন্দটা ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড বুঝিয়ে দিলেন ইনস্টাগ্রাম পোস্টে।

চ্যাম্পিয়নস লিগ নেইমার আগেও জিতেছেন। ২০১৫ সালে সে শিরোপার পথে কোয়ার্টার ফাইনালের দুই লেগ, সেমিফাইনালের দুই লেগ ও ফাইনাল—পাঁচ ম্যাচের প্রতিটিতে গোলও করেছিলেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড। কিন্তু বার্সেলোনার জার্সিতে জেতা সেই চ্যাম্পিয়নস লিগ যতটা না নেইমারের, তার চেয়েও বেশি যে লিওনেল মেসির! আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড যে বার্সেলোনার প্রাণ সব সময়ই ছিলেন, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু নেইমারের যে নিজেকে প্রমাণের দায় ছিল! মেসি বা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো করে দাপট নিয়ে নিজের মতো করে, ‘নিজের’ একটা দলকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর চ্যালেঞ্জ।

২০১৭-১৮ মৌসুমে পাওয়া চোট।
ইনস্টাগ্রাম

যে চ্যালেঞ্জের খোঁজে পিএসজিতে এসে প্রথম দুই মৌসুমে হোঁচট খেতে হয়েছে নেইমারকে। সদাহাস্য ব্রাজিলিয়ানকে কাঁদিয়েছে চোট। দুবারই চ্যাম্পিয়নস লিগের একই পর্বে, দুবারই চোটটা শরীরের একই জায়গায়। ২০১৭-১৮ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে শেষ ষোলোর প্রথম লেগটা খেলতে পেরেছিলেন নেইমার। রিয়ালের মাঠে সে ম্যাচে অবশ্য ৩-১ গোলে হেরে যাওয়ায় এমনিতেই পিএসজির পরের পর্বে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে গিয়েছিল অনেকটা। দ্বিতীয় লেগে কিলিয়ান এমবাপ্পে ছিলেন বটে, কিন্তু যাঁকে ঘিরে সব স্বপ্ন সাজিয়েছিল পিএসজি, সেই নেইমার দ্বিতীয় লেগের আগে পড়লেন চোটে। ডান পায়ের পঞ্চম মেটাটারসালে চোট।

পরের মৌসুম। শেষ ষোলোতে প্রতিপক্ষ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ভাঙাচোরা ইউনাইটেডই। হোসে মরিনহোকে বিদায় দিয়ে উলে গুনার সুলশারের অধীনে শুরুটা অবশ্য দারুণ হচ্ছিল ইউনাইটেডের, কিন্তু নেইমার-এমবাপ্পে-ডি মারিয়াদের পিএসজির সামনে ইউনাইটেড দাঁড়াতে পারবে—এমনটা ভেবেছিলেন খুব কম লোকেই। কিন্তু আবার চোট নামের খলনায়ক এসে দাঁড়াল নেইমারের সামনে। এবারও সেই ডান পায়ের পঞ্চম মেটাটারসালেই!


এবার শেষ ষোলোর একটা ম্যাচেও খেলতে পারেননি নেইমার। প্রথম লেগে ইউনাইটেডের মাঠে এবার ২-০ গোলে জেতে পিএসজি, কিন্তু দ্বিতীয় লেগে ভজকট! শেষ মুহূর্তের পেনাল্টিতে পিএসজির মাঠ ইউনাইটেড জিতে গেল ৩-১ গোলে! আগের মৌসুমের মতো এবারও গ্যালারিতে অসহায় দর্শকের চোখে নেইমার দেখলেন, তাঁকে ছাড়া পিএসজির স্বপ্নের কীভাবে জলাঞ্জলি হলো! তাঁর নিজের স্বপ্নেরও কি নয়?
দুই মৌসুমে স্বপ্নভঙ্গ হয়তো নেইমারকে মানসিকভাবে আরও কঠিন বানিয়েছে। প্রত্যয়ে বদ্ধ হয়েছে তাঁর চোয়াল। এবার শরীরটাও সায় দিয়েছে প্রত্যয়ে।

২০১৮-১৯ মৌসুমেও তাঁকে কাঁদিয়েছে চোট।
ইনস্টাগ্রাম

করোনাভাইরাস এসে মৌসুমটাকেই ভেস্তে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল বটে, কিন্তু সেটি পাশ কাটিয়ে ফুটবল শুরু হতেই নেইমারের মুগ্ধতা ছড়ানোর শুরু। করোনার হানার আগেই কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে রেখেছিল পিএসজি, কোয়ার্টার ফাইনালে এই মৌসুমের এক চমক আতালান্তার বিপক্ষে নেইমারের ঝলকেই শেষ মুহূর্তে উদ্ধার পেল পিএসজি। হ্যাঁ, নেইমার অবিশ্বাস্যভাবে গোল করার কয়েকটি সুযোগ হাতছাড়া করেছেন। কিন্তু একেবারে শেষ দিকে তিন মিনিটের দুই গোলে যে ২-১ ব্যবধানে জিতল পিএসজি, তা তো নেইমারের ঝলকেই। ম্যাচজুড়েই পিএসজির সব আক্রমণের প্রাণ ছিলেন নেইমার।

সেমিফাইনালে কাল প্রতিপক্ষ হয়ে এসেছিল মৌসুমের আরেক চমক লাইপজিগ। আরেকবার ঝলক নেইমারের। সঙ্গে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়ার ঝলক মিলিয়ে এবার দাপুটে জয় পিএসজির। ৩-০ গোলের জয় পিএসজিকে নিয়ে গেল ক্লাবটার ইতিহাসের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে। প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা আর পিএসজির মধ্যে দূরত্ব আর ৯০ মিনিটের। কিংবা ১২০ মিনিট। কিংবা ১২০ মিনিট ও টাইব্রেকারের। সামনে প্রতিপক্ষ হয়ে আসবে বায়ার্ন মিউনিখ, নয়তো শেষ দিকে এসে মৌসুমে চমক দেখানো আরেক দল লিওঁ।

এবার নেইমারের এই মাটিতে শুয়ে পড়া প্রার্থনায়।
ইনস্টাগ্রাম

শেষ বাঁশিতে ফাইনাল নিশ্চিত হতেই কাল মাঠে শুয়ে পড়লেন নেইমার। মাথা মাটিতে ঠেকানো। হাত দুটি জোড় করে ওঠানো মাথার ওপরে। প্রার্থনায়। ইনস্টাগ্রামে সে ছবি, আর আগের দুই মৌসুমের দুটি ছবি দিয়ে নেইমার পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রামে। আগের দুই মৌসুমে তাঁর চোটে পড়ার দুই মুহূর্তের ছবি। ছবিগুলোর নিচে নেইমারের দেওয়া ক্যাপশনটা পিএসজিতে তিন মৌসুমে তাঁর স্বপ্নভঙ্গ ও ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প, ‘২০১৮—মাটিতে পড়ে থাকা। চোটে। ২০১৯—মাটিতে পড়ে থাকা। চোটে। ২০২০—মাটিতে পড়ে থাকা। ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতায়।’

ফাইনালে ওঠার খুশি কতটা, তার প্রমাণ নেইমারের পরের কথাগুলো, ‘টানা দুই বছর গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে—আমার জন্য, দলের জন্য খুব মুহুর্তে—চোটে পড়েছিলাম। আজ আমি সম্পূর্ণ, কোনো চোট নেই। এবং আমি আমার সতীর্থদের আমার জানা সবচেয়ে ভালো উপায়ে সাহায্য করতে পারছি। আমি অনেক অনেক খুশি, অনেক খুশি!’
তবে এ তো খুশির একটা ধাপ, বড় ধাপটা তো এখনো বাকিই। নেইমারের কি তা মনে নেই! শিরোপামঞ্চে দৃষ্টি পিএসজির প্রাণভোমরা ব্রাজিলিয়ানের, ‘আজ আমরা ইতিহাস গড়েছি। কিন্তু আমরা এখানেই থামতে চাই না। আরও বেশি কিছু চাই। ওই কাপটা, ওই কানটা (চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফিকে ‘বিগ ইয়ার’ বা বড় কানও বলা হয়), ওই ট্রফিটা নিয়ে আসি, চলো!’


নেইমার যেমন ছন্দে, তাতে সেটি খুবই সম্ভব! তা প্রতিপক্ষ বায়ার্নই হোক, বা লিওঁ।