ফেসবুক-টুইটারের অশুভ প্রভাব কাটবে কীভাবে

টুইটার-ফেসবুক
টুইটার-ফেসবুক

গণতন্ত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব এড়াতে এটি নিয়ন্ত্রণ করে সুফল পাওয়া যায় না। তাই বাহ্যিক নানা কলাকৌশল খাটিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে প্রযুক্তি–সচেতনতা তৈরির পথে হাঁটা উচিত। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি চাওয়া উচিত।

নিরপেক্ষ ফোরাম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ধারণা ঠিক প্রমাণিত হয়নি। ক্ষমতার কাঠামো সুরক্ষিত করতে মানুষের বিভিন্ন উদ্ভাবনকে উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহারের ঘটনা আগেও ঘটেছে। ছাপা কাগজ, টেলিগ্রাফ থেকে শুরু করে কেব্‌ল টিভির ক্ষেত্রেও স্বাধীন প্রযুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করে সামাজিক দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম ও বড় প্রযুক্তির আগ্রাসন জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বিষয়টি নিয়ে ‘ডু সোশ্যাল মিডিয়া থ্রেটেন ডেমোক্রেসি’ শিরোনামে প্রচ্ছদ প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে।

সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট নিয়ে এখন মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। বিশেষ করে ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ভূমিকা ও রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। টুইটার, গুগল, ফেসবুকের মতো বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের শুনানিতে হাজির হতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হাউস পার্মানেন্ট সিলেক্ট কমিটি অন ইনটেলিজেন্সের চেয়ারম্যান রিচার্ড বার মনে করেন, রাশিয়া বিভিন্ন বট ও ভুয়া খবর ছড়িয়ে তথ্য অপারেশন চালিয়েছে, যাতে সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। জাতি, অভিবাসন ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিমত তৈরি হয়েছে। ওই কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ওয়ার্নার এই বলে সতর্ক করেছেন, মার্কিন নির্বাচনের সময় রাশিয়া থেকে ৮০ হাজার ফেসবুক পোস্ট দেওয়া হয়, যা ১২ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন নাগরিক দেখেছেন। টুইটারের ১৫ শতাংশ অ্যাকাউন্ট ভুয়া। এসব অ্যাকাউন্ট সফটওয়্যার চালিত।
টুইটার কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, ২০১৬ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের সময় রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত অ্যাকাউন্ট থেকে ১৪ লাখ টুইট করা হয়। টুইটার, গুগল ও ফেসবুককে তাই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে এ প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে, যাতে এ ধরনের ভুয়া প্রচার চালানো ঠেকানো যায়, সে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে।

শুনানির সময় এক বিবৃতিতে টুইটার কর্তৃপক্ষ বলেছে, রাশিয়ান সরকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময় রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোর বিজ্ঞাপন বাতিল করবে তারা। এরপরপরই রাশিয়া টাইমসের সম্পাদক মার্গারিটা সিমোনিয়ান পাল্টা মন্তব্য করে বলেছেন, ‘টুইটারের পক্ষ থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময় রাশিয়ার সংবাদ সংস্থাগুলোর কাছে বিজ্ঞাপনে বিনিয়োগ আহ্বান করা হয়। টুইটার যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে, তা বাক্‌স্বাধীনতার ওপর আঘাত। আরেকটি বিষয় পরিষ্কার যে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এ সেবাটি।’

সিমোনিয়ানের এ মন্তব্য ভূরাজনৈতিক বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর নিরপেক্ষ থাকার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করে। বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্ব–আরোপিত ব্যবসা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে আটকে পড়ে ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের বিষয়টি।

ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য দেখার ক্ষেত্রে ফেসবুকের ক্ষমতা নিয়ে সিনেটের শুনানিতে সম্প্রতি লুইজিয়ানার জুনিয়র সিনেটর জন কেনেডি ও ফেসবুকের জেনারেল কাউন্সেল কলিন স্টেচের মধ্যেকার বিতর্ক তারই প্রমাণ।

এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ও ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা মালিকানা, বিজ্ঞাপন ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে খবরের দখল নিচ্ছেন। আধুনিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এমন অ্যালগরিদম দিয়ে তৈরি হচ্ছে, যার হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকবে তার কথামতো বা যাঁরা অর্থ পরিশোধ করবে তাদের কথামতো পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে নিরপেক্ষতার বিষয়টি প্রশ্নের মুখে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে বাহ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রক্রিয়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, এসব প্ল্যাটফর্মের নিজস্ব কাঠামোগত সমস্যা আছে। এর মূল সমস্যা হচ্ছে অ্যালগরিদমে। এটা নিখুঁত করার পরিবর্তে মুনাফা করার জন্য তৈরি করা হয়। মনে রাখতে হবে, এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এসব সাইট তৈরি করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের থিংকট্যাঙ্ক দ্য ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ভিজিটিং ফেলো জন হুইলার বলেন, এসব অ্যালগরিদমের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবহারকারীর আকর্ষণ বাড়ানো এবং মুনাফা বৃদ্ধিকারী বিজ্ঞাপনদাতাদের টেনে আনা। যেসব কনটেন্ট ব্যবহারকারী পছন্দ করেন তা তুলে আনাই এসব অ্যালগরিদমের উদ্দেশ্যে।

প্ল্যাটফর্মের মতোই সার্চ ইঞ্জিন খাতও বহুজাতিক পুঁজিবাদ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গুগল এখন আর শুধু তথ্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে না। জ্ঞানের চালক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখে গুগল। বিভিন্ন অ্যালগরিদমের মাধ্যমে কনটেন্ট ছেঁকে ব্যক্তি পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী বিভিন্ন পণ্য সম্পর্কে তথ্য হাজির করে গুগল। নিরপেক্ষ থাকার পরিবর্তে নিজের পণ্যগুলো প্রাধান্য দিতে অনুসন্ধান ফলাফলে হাত দেয় গুগল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কনটেন্ট ছড়ানোর সঙ্গে যুক্ত সব প্ল্যাটফর্মকে পাবলিক ইন্টারেস্ট অ্যালগরিদম বা মানসম্মত জনকল্যাণমূলক অ্যালগরিদম তৈরি করতে হবে।

বিশেষজ্ঞ ওয়ায়েল ঘোনিম ও জ্যাক র‍্যাসবাস বলেন, তিনভাবে মানুষের দরকারি অ্যালগরিদম তৈরিতে বাধ্য করা যায়। প্ল্যাটফর্মগুলোকে অবশ্যই পাবলিক পোস্ট সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে। কীভাবে নির্দিষ্ট পোস্ট ট্রেন্ডিং থেকে ভাইরাল হচ্ছে সে তথ্য প্রকাশ করতে হবে। বিজ্ঞাপন সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে যাতে গ্রাহক সঠিক তথ্য পেতে পারে। এ ছাড়া নীতিমালাগত স্বচ্ছতা আনতে হবে।

মন্দ দিক থাকলেও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের একত্র, বাধা দেওয়া ও সাহায্য করার সম্মিলিত ক্ষমতা আছে, যা আগে কল্পনা করা যেত না। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এ প্রভাব ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। দুর্যোগের সময় ত্রাণ, সামাজিক আন্দোলন ও সত্যিকারের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এর ক্ষমতা অবহেলা করার মতো নয়। বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তৈরি করতে হবে, যাতে উন্নত বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব।