প্রযুক্তি আসক্তি আসলে কী?

প্রযুক্তি আসক্তি কোন মাত্রায় পৌঁছালে এমন ঘটনা ঘটতে পারে! অধুনার এই আয়োজনে মডেল হয়েছেন সাদিয়া ও রনি। ছবি: সুমন ইউসুফ
প্রযুক্তি আসক্তি কোন মাত্রায় পৌঁছালে এমন ঘটনা ঘটতে পারে! অধুনার এই আয়োজনে মডেল হয়েছেন সাদিয়া ও রনি। ছবি: সুমন ইউসুফ

লিফটে এক ভদ্রলোক চারতলায় যাবেন বলে উঠলেন। কিন্তু লিফটে উঠেই তিনি তাঁর মুঠোফোনে এমন মশগুল হয়ে গেলেন যে চারতলার বোতাম চাপতেই ভুলে গেলেন। খানিক বাদে তাঁর হুঁশ ফিরে এল। ততক্ষণে লিফট ছয়তলায় পৌঁছে গেছে। তড়িঘড়ি করে একবার দরজা, একবার লিফটের বোতামগুলো দেখতে দেখতে হতাশ হয়ে আবার মুঠোফোনে মনোযোগ দিলেন। আমরা কি তাঁকে প্রযুক্তি আসক্ত বলব? আবার তিনি তো দরকারি ই-মেইল পাঠানোর জন্যও মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারেন।

ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট শন পার্কার গত নভেম্বরে এক সম্মেলনে বলেই বসেন যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরি করা হয়েছিল মানুষকে বিচ্ছিন্ন করতে, এক সুতোয় বাঁধতে নয়। তাঁর ভাষ্যমতে, ব্যাপারটা এমন—কীভাবে ব্যবহারকারীর আরও বেশি সময় নষ্ট করা যাবে, কীভাবে তাঁদের মনোযোগ কেড়ে নেওয়া যাবে সেটিই ছিল উদ্দেশ্য। ফেসবুক প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই শন পার্কার পদত্যাগ করেন। হয়তো কোনো ক্ষোভ ছিল বলেই এমন ঠোঁটকাটা মন্তব্য করেছেন। তবে তাঁর কথার কোথাও কিন্তু কোনো ভুল নেই। ফেসবুক আমাদের মনোযোগ চায়। তাদের ব্যবসায়িক মডেলটাই এমন। কাজটি কীভাবে করে? উত্তর হলো, ব্যবহারকারীর মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে।
মজার ব্যাপার হলো, যে মার্কিনদের দেশে ফেসবুক-স্ন্যাপচ্যাট তৈরি হয়েছে, তারাই এখন বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। সেখানে এখন দেশজুড়ে প্রচারণা চলছে শিশুদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে। ‘ট্রুথ অ্যাবাউট টেক’ নামের সেই প্রচারণা অভিযানের প্রতিপাদ্য হলো, শিশুদের নরম মন যেন ডিজিটাল প্রযুক্তির চাপে বদলে না যায়, অজান্তেই যেন তারা শোষিত না হয়। প্রচারণা চলছে ভিন্নভাবে। তারা সরাসরি শিশুদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে বলছে না। বরং তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করছে, শিশুদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দিলে কী কী ক্ষতি হতে পারে। আপনার শিশুর ভালো চান না মন্দ চান—সিদ্ধান্ত আপনার।

প্রযুক্তি আসক্তি কী?
কম্পিউটার, স্মার্টফোন, গেমিং সিস্টেম—বিশেষ করে পর্দায় কাজ করা যায় এমন যেকোনো যন্ত্রের প্রতি তীব্র টান হলো প্রযুক্তি আসক্তি। বিশেষ করে কিশোরদের মধ্যে প্রযুক্তি আসক্তি দেখা গেলেও সব বয়সের মানুষই এতে আসক্ত হতে পারে। প্রযুক্তি আসক্তি মানুষে মানুষে সম্পর্কের সূক্ষ্ম দিকগুলো দুর্বল করে দেয়। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব নিউরোসাইকিয়াট্রিক মেডিসিন অনুযায়ী প্রতি আটজন মার্কিন নাগরিকের একজন প্রযুক্তিতে আসক্ত।

আমাদের দেশে তেমন কোনো পরিসংখ্যান বা গবেষণা না থাকলেও আশপাশে তাকালে বোঝা যায়, প্রযুক্তি আসক্তি বাড়ছে। একই পরিবারের চারজন হয়তো গেছেন রেস্তোরাঁয় খেতে, খাবার আসার আগ পর্যন্ত দেখা গেল চারজন নিজ নিজ স্মার্টফোন বা ট্যাবে ব্যস্ত। আবার এমনও আছে, এক হাতে ফোন ধরে অন্য হাতে খাচ্ছে। অনেকের আবার অভ্যাস, ফেসবুকে চ্যাট করতে করতে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন। আবার দুজন হয়তো সময় কাটাতে কোথাও গেছেন, কিন্তু সুন্দর পরিবেশে দুজন দুজনের সঙ্গে কথা বলার বদলে হয়তো নিজ নিজ মোবাইল ফোনেই সময় কাটাচ্ছেন। অনেক সময় পরস্পরের কাছে এসেও কাছে আসা যায় না। বাধা হয় প্রযুক্তি। এগুলো একধরনের প্রযুক্তি আসক্তিই।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রযুক্তি আসক্তি অনেক ধরনেরই হতে পারে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি থাকতে পারে। আমরা তখনই কোনো মানুষকে প্রযুক্তি আসক্ত বলব, যখন তাঁর মধ্যে দুটি বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে। এক. দিনে দিনে যন্ত্রে সময় কাটানোর হার বাড়বে। দুই. প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকলে শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে।’

সাধারণভাবে তো বলাই যায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটার, ট্যাব বা স্মার্টফোনে পর্দায় থাকাটা প্রযুক্তি আসক্তি। কিন্তু পেশাগত কারণে যাঁদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রযুক্তির সঙ্গে কাটাতে হয়, তাঁদেরটাও কি আসক্তি? কাজের জন্যই কম্পিউটার প্রোগ্রামার, অ্যানিমেটর, গ্রাফিক ডিজাইনার বা কলসেন্টার কর্মীদের যন্ত্রের সঙ্গে থাকতে হয় দিনের দীর্ঘ সময়। আহমেদ হেলালের মতে এটা আসক্তি নয়। কারণ, এটা কাজ। বরং এক দিন কাজের জন্য পর্দায় না থাকলে ব্যক্তি তো খুশিই হয়। তিনি বলেন, ‘অফিসের কম্পিউটারে শুধু কাজটাই করতে হবে। এর বাইরে অন্য কিছু করা যাবে না।’

প্রযুক্তি আসক্তির ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কেও বললেন আহমেদ হেলাল। তাঁর মতে, সামাজিকতা থেকে দূরে থাকা, কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, পারিবারিক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হওয়া, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা—প্রযুক্তি আসক্তি থেকে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে।

কীভাবে প্রযুক্তি আসক্তি তৈরি হয়
চিকিৎসাশাস্ত্রে এখনো ঠিক প্রযুক্তি আসক্তি বলে কিছু যোগ হয়নি। ঠিক কী কারণে প্রযুক্তি আসক্তি তৈরি হয়, তা–ও পরিষ্কার নয়। গবেষকদের দাবি, এটা হয়তো সহজাত জিনগত বৈশিষ্ট্য এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে হয়ে থাকে।

সম্ভাব্য তিনটি কারণ—
ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য
যাঁরা প্রযুক্তিতে আসক্ত তাঁদের অনেকের মধ্যেই দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, বিষণ্নতা—এ ধরনের রোগ দেখা যায়। তাঁরা সাধারণত একটু আবেগপ্রবণ হয়ে থাকেন।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
যাঁরা একটু অন্তর্মুখী, সরাসরি সামাজিক যোগাযোগ থেকে দূরে থাকেন, তাঁরাই মানুষের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর এভাবেই তাঁরা একসময় প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়েন।

পারিপার্শ্বিক পরিবেশ
যাঁরা দৈনন্দিন কাজে প্রচুর চাপে থাকেন, তাঁদের মধ্যে সেই চাপ কমানোর মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তিভিত্তিক যন্ত্রের ব্যবহার বেছে নিতে দেখা গেছে।