তিনি দেশের প্রথম নারী প্রোগ্রামার

শাহেদা মুস্তাফিজ এখনো যুক্ত আছেন সফটওয়্যার তৈরির সঙ্গে। ছবি: সুমন ইউসুফ
শাহেদা মুস্তাফিজ এখনো যুক্ত আছেন সফটওয়্যার তৈরির সঙ্গে। ছবি: সুমন ইউসুফ

নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় বলেন, প্রায় অবসরপ্রাপ্ত। ‘৪০ বছর তো করলাম, আর কত?’ তবে এখনো সফটওয়্যার তৈরির সঙ্গে যুক্ত আছেন তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশের প্রথম নারী কর্মী শাহেদা মুস্তাফিজ। বর্তমানে সন্তানের সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। ৭ মার্চ রাজধানীর বনানীতে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় এই চার দশকের কর্মজীবন নিয়ে।

তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের জন্য বর্তমান সময়টা চমৎকার। তবে চার দশক আগে কেমন ছিল? সে সময় হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো মূলত বিদেশে সফটওয়্যার রপ্তানি করত। কর্মীরা সব পুরুষ। সে সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ানো হতো না। শাহেদা মুস্তাফিজ পড়াশোনা করেছেন অর্থনীতিতে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের এনসিআর করপোরেশনে সফটওয়্যার আর্কিটেকচার নিয়ে এক বছরের প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭৬ সালে সে প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ শাখায় সিস্টেমস ম্যানেজার হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। পরবর্তী সময় বাংলাদেশে এনসিআরের কার্যক্রম লিডস করপোরেশন কিনে নিলে লিডসে শুরু হয় তাঁর কাজ। দেশে ব্যাংকে অটোমেশন বা ব্যাংকিং সফটওয়্যার তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন শাহেদা।

প্রথমে এনসিআর ও পরে লিডসে ২২ বছর কাজ করে ১৯৯৮ সালে ইস্তফা দেন শাহেদা মুস্তাফিজ। এরপর কাজ শুরু করেন প্রবিতি সিস্টেমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। তাঁর এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। এ ছাড়া তিনি কানাডার টোয়েন্টি-টোয়েন্টি টেকনোলজিস ইনকরপোরেটেডের বাংলাদেশ শাখায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ই-টেকলজিকস ইনকরপোরেটেডের বাংলাদেশ শাখায় নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। কাজের বাইরে তিনি শিশুদের জন্য এবং বিশেষ করে নারীদের জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করেছেন।

৪০ বছর আগের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য হারে না। শাহেদা মুস্তাফিজ মনে করেন, এর পেছনে একটা কারণ হলো নারীদের দুটো সমান্তরাল জীবন আছে, দুটোই গুরুত্বের সঙ্গে চালাতে হয়। তিনি বলেন, ‘৪০ বছর আগের সঙ্গে তুলনা করলে দেশ এখন অনেক এগিয়েছে। সব দিক দিয়েই এগিয়েছে। শুধু নারীদের কাজটা এখনো সেই আগের মতোই আছে। এখনো সন্তান-সংসারের পুরো দায়িত্ব নারীর একার। আমাদের কর্মজীবন আর পারিবারিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্য করে চলতে হয়। আর কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের জন্য পুরোটা সময় এর ভেতরেই থাকতে হয়। আমাদের সমাজে এটা সব সময় সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।’

প্রোগ্রামিংয়ে নারীরা কম আসে ঠিকই, তবে যারা আসে তারা কিন্তু আবার খুব ভালো কাজ করে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জানান, ‘আমার দলে অনেক নারী কর্মী কাজ করেছেন। এই দলটা চমৎকার কাজ করত।’

আমাদের দেশে সেবা হিসেবে সফটওয়্যার শিল্পের যা কিছু বিকাশ হয়েছে, পণ্য হিসেবে তা হয়নি। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুযায়ী সফটওয়্যার বা তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দেওয়ার রীতি আছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান যখন একটা সফটওয়্যার তৈরি করে বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করতে যায়, তা পারে না। শাহেদা মুস্তাফিজ বলেন, ‘আমাদের দেশে সফটওয়্যারের বাজার সেভাবে তৈরি হয়নি। সফটওয়্যারের যে আলাদা দাম থাকতে পারে, তা-ই অনেকে বুঝতে চান না। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ খরচ করে সফটওয়্যার আমদানি ঠিকই করে, শুধু দেশি প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যারের মূল্য পরিশোধ করতে প্রতিষ্ঠানগুলোর যত আপত্তি। কিন্তু বুঝতে হবে তো একটা সফটওয়্যার তৈরির পেছনে কত পরিশ্রম থাকে, কত সময় লাগে।’

খুব শিগগিরই পূর্ণ অবসরে যেতে চান শাহেদা মুস্তাফিজ। তবে তার আগে হাসপাতাল অটোমেশন সফটওয়্যারের কাজ শেষ করতে চান। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে তাহলে দুটো অর্জন থাকবে। একটা ব্যাংক অটোমেশন সফটওয়্যার, আর দ্বিতীয়টা হাসপাতালের জন্য।’