ছায়াপথের কেন্দ্রে ছোট কৃষ্ণগহ্বরের মেলা!

মিল্কিওয়ে বলে পরিচিত ছায়াপথের কেন্দ্রে ছোট অনেক কম ভরের কৃষ্ণগহ্বর আছে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অলংকরণ। ছবি: রয়টার্স।
মিল্কিওয়ে বলে পরিচিত ছায়াপথের কেন্দ্রে ছোট অনেক কম ভরের কৃষ্ণগহ্বর আছে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অলংকরণ। ছবি: রয়টার্স।

আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে ছোট আকারের অজস্র কৃষ্ণগহ্বর আছে বলে ধারণা করছেন গবেষকেরা। কয়েক বছর ধরে কসমিক গ্যাসের আভা পর্যালোচনা করে কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে নতুন তথ্য জানালেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।

কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক চাক হেইলি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করছেন। ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত বিশাল কৃষ্ণগহ্বরের গ্রাসে পরিণত হওয়া কসমিক গ্যাসের আভা নিয়েই কাজকারবার তাঁর। জ্যোতির্বিদেরা রঞ্জন রশ্মি ব্যবহার করে ওই আভা ধরতে পারেন।

গবেষকেরা দেখেন, ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে বের হওয়া কিছু রঞ্জন রশ্মির উৎস ওই কৃষ্ণগহ্বর। এটি স্যাগিটারিয়াস এ* নামে পরিচিত। কিন্তু সব রশ্মির উৎস আবার ওই বিশাল কৃষ্ণগহ্বর নয়। অন্যগুলো আসে ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট আকারের কৃষ্ণগহ্বর থেকে। গবেষকেরা দীর্ঘদিন ধরেই ছায়াপথের কেন্দ্রে এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বর থাকার বিষয়টি ধারণা করছিলেন। তাঁরা ভাবতেন, ছায়াপথের কেন্দ্রে শত শত কৃষ্ণগহ্বর থাকতে পারে। গবেষক হেইলি ও তাঁর সহকর্মীরা এ বিষয়টির প্রমাণ পেয়েছেন।

পৃথিবীকে আবর্তন করা চান্দ্রা এক্স-রে অবজারভেটরি থেকে তথ্য ব্যবহার করেন গবেষকেরা। গবেষক হেইলির নেতৃত্বে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল ছায়াপথের কেন্দ্রের কয়েক আলোকবর্ষ দূরের ১২টি রঞ্জন রশ্মির উৎস বেছে নেন এবং ধারণা করেন, এগুলো ছোট কৃষ্ণগহ্বর থেকে আসছে।

এই গবেষণাবিষয়ক নিবন্ধ ‘নেচার’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষকেরা বলছেন, তাঁরা যে এক ডজন কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করেছেন, সেগুলো সূর্যের ভরের তুলনায় ১০ গুণ। এগুলো খুবই ছোট আকারের কৃষ্ণগহ্বর। কিন্তু সূর্যের চেয়ে ৪০ লাখ গুণ বেশি ভরের বিশাল কৃষ্ণগহ্বর সেখানে আছে।

গবেষকেরা বলেন, ছোট এসব কৃষ্ণগহ্বরের শিকার হওয়া নক্ষত্রগুলো খুঁজতে গিয়ে তাদের খোঁজ পাওয়া যায়। যখন কৃষ্ণগহ্বর একটি নক্ষত্রের সঙ্গে আবর্তিত হয়, তখন এর সঙ্গী নক্ষত্রটির সবকিছু গ্রাস করে ফেলে। এর ছায়ায় হারিয়ে যেতে থাকে নক্ষত্রের আলো। নক্ষত্রের সঙ্গে আবর্তিত হওয়ার এ পদ্ধতিকে বাইনারি সিস্টেম বলে। ধীরে ধীরে সঙ্গী নক্ষত্রকে গ্রাস করার সময় গরম গ্যাসের উজ্জ্বল চাকতি তৈরি হয়। এটিকে শক্তিশালী টেলিস্কোপের রঞ্জন রশ্মি দিয়ে দেখা যায়। হাজারো কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যেও তাই হেইলি ও তাঁর দল এ কৃষ্ণগহ্বরগুলো শনাক্ত করতে পেরেছেন।

হেইলি ও তাঁর দলের ধারণা, ছায়াপথে ১০ হাজারের মতো ছোট আকারের কৃষ্ণগহ্বর থাকতে পারে। জ্যোতির্বিদদের পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা এ অনুমান করছেন। তাঁরা বলছেন, এ কৃষ্ণগহ্বর যদি ছায়াপথের কেন্দ্রে হতো, তবে তা এতটাই অনুজ্জ্বল থাকত, যা পৃথিবী থেকে শনাক্ত করা কঠিন। এগুলোর অধিকাংশই দেখতে পাওয়া যায় না, কারণ ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে তা অনেক দূরে।

নতুন সন্ধান পাওয়া ছোট আকারের এসব কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে চমকে উঠেছেন হেইলি। তাঁর মতে, যাদের সঙ্গী নক্ষত্র নেই, এমন কত কৃষ্ণগহ্বর ভেসে বেড়াচ্ছে, যা টেলিস্কোপে ধরা পড়ছে না। অসংখ্য কৃষ্ণগহ্বর সঙ্গীহীন থাকতে পারে।

আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ প্রকল্পের সদস্য সেরা মার্কস বলেন, ‘আমাদের ছায়াপথে অসংখ্য ছোটখাটো কৃষ্ণগহ্বরে ভরা—এমন তথ্যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমাদের ছোট পৃথিবীর জন্য এগুলো হুমকি নয়। তবে কেউ যদি ছায়াপথের কেন্দ্রে যান, তবে বড় কৃষ্ণগহ্বরের মতোই ছোটগুলো ভয়ংকর হয়ে দেখা দিতে পারে।’

প্রতিটি কৃষ্ণগহ্বরের ‘ঘটনা দিগন্ত’ নামের অদৃশ্য সীমানা আছে। এ থেকে কোনো কিছু এমনকি আলোও বের হয়ে আসতে পারে না। ওই দিগন্ত যে পার করে, সে-ই চিরতরে হারিয়ে যায়। কেউ যদি ওই ঘটনা দিগন্তে যায়, তবে ভয়ংকর মহাকর্ষীয় টানে তা হারিয়ে যাবে। কৃষ্ণগহ্বর যত ছোট, তার এই টেনে নেওয়ার শক্তি তত বেশি বা সেটি তত বেশি ঘনত্বের।

মহাজাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধরলে ছায়াপথের কেন্দ্রে কোনো জীবিত প্রাণী টিকতে পারবে না। এটা সৃষ্টির স্থান। হেইলির মতে, মহাজাগতিক বস্তুর সৃষ্টিস্থান এটি। এটি ঠিক উর্বর ভূমির মতো, যেখানে বড় বড় নক্ষত্র বেড়ে ওঠে এবং কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন হয়ে আরেকটি নক্ষত্রকে গ্রাস করে।