সিলিকন ভ্যালি থেকে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কমতে শুরু করেছে

সিলিকন ভ্যালি। ছবি: এএফপি
সিলিকন ভ্যালি। ছবি: এএফপি

একসময় যাকে বলা হতো স্টার্টআপ বা উদ্যোগের স্বপ্নভূমি, সেই সিলিকন ভ্যালির প্রতি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে এক শিল্পাঞ্চলের নাম সিলিকন ভ্যালি। সিলিকন ভ্যালি বিশ্বের নেতৃস্থানীয় উচ্চ প্রযুক্তির বাণিজ্যিক এলাকা। বিশ্বের বড় বড় সফটওয়্যার, ইলেকট্রনিকস পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই এখানে অবস্থিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গুগল, ইন্টেল করপোরেশন, হিউলেট-প্যাকার্ড (এইচপি), অ্যাপল কম্পিউটারস ইনকরপোরেটেড, ওরাকল, ইয়াহু ইত্যাদি। সিলিকন ভ্যালির প্রতি উদ্যোক্তাদের আকর্ষণ কমে যাওয়ার কারণ ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

একসময় ছোট ছোট উদ্যোগ কুঁড়ির মতোই ফুল হয়ে বিকশিত হতো সিলিকন ভ্যালিতে। ইকোনমিস্ট বলছে, প্রযুক্তি হাব হিসেবে সিলিকন ভ্যালির আধিপত্য হ্রাস পাচ্ছে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিলিকন ভ্যালির পরিবর্তে অন্যান্য শহরে উদ্যোগ গড়ে তুলছেন উদ্যোক্তারা।

সিলিকন ভ্যালিকে যেন রেনেসাঁর শহর ফ্লোরেন্সের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি রাজধানী হিসেবে বিশ্ব অর্থনীতি, শেয়ারবাজার আর সংস্কৃতিতে এর অবদান প্রচুর। সান হোসে থেকে সানফ্রান্সিসকোর মধ্যকার অঞ্চলটিতেই বিশ্বের সবচেয়ে দামি পাঁচটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে অ্যাপল, ফেসবুক, গুগল নেটফ্লিক্সের জন্ম।

একে শুধু স্থান বললেই ভুল বলা হয়। একে বলা চলে একটি ধারণা। বিল হিউলেট আর ডেভিড প্যাকার্ড ৮০ বছর আগে একটি গ্যারেজে প্রতিষ্ঠান শুরুর পর থেকে এটি উদ্ভাবনী ধারণার সূতিকাগার হয়ে উঠেছে। এখান প্রকৌশল দক্ষতা, ব্যবসার নেটওয়ার্ক, উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় ও ঝুঁকি নেওয়ার সংস্কৃতি একে অনন্য করেছে। সহজে সিলিকন ভ্যালির নকল করা যাবে না। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো দেশে এর প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হয়নি। কিন্তু তাই বলে কি সিলিকন ভ্যালির প্রভাব কমবে না? অন্য কোথাও হয়তো সিলিকন ভ্যালির চেয়েও উন্নত উদ্ভাবন শুরু হয়ে গেছে। সত্যিটা চোখে পড়তে শুরু করেছে।

প্রথমেই বলা যায়, সিলিকন ভ্যালিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। শুধু গত বছরে সানফ্রান্সিসকোতে যত মার্কিন নাগরিক এসেছেন, তার চেয়ে এ এলাকা ছেড়েছেন বেশি। সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, আগামী বছরেই মধ্যে ৪৬ শতাংশ মানুষ বে এরিয়া ছাড়তে চান, যা ২০১৬ সালে ছিল ৩৪ শতাংশ। এখন ‘অব সিলিকন ভ্যালেয়িং’ ট্রেন্ড বা সিলিকন ভ্যালির বাইরের ট্রেন্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেক উদ্যোক্তা ওই এলাকার বাইরে চলে যাচ্ছেন। বড় উদাহরণ হচ্ছেন পিটার থায়েল। সিলিকন ভ্যালির সুপরিচিত ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বা উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী তিনি। ২০১৩ সালে যেখানে অর্ধেকের বেশি সিলিকন ভ্যালির বে এরিয়ার উদ্যোগগুলোয় বিনিয়োগ করা হতো, তা এখন কমে গেছে।

সিলিকন ভ্যালিতে আগ্রহ হারানোর কারণ কী? ইকোনমিস্ট বলছে, নানা কারণেই উদ্যোক্তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে সিলিকন ভ্যালির ব্যয় বেড়ে যাওয়া। সেখানে বসবাস করতে হলে যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তা অত্যন্ত বেশি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বসবাসের ব্যয় সিলিকন ভ্যালি এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শহরে ব্যবসা পরিচালনার করার যত খরচ, তার চেয়ে সিলিকন ভ্যালি এলাকায় ছোট উদ্যোক্তাদের ব্যবসা করতে চার গুণ বেশি খরচ হয়।

এ ছাড়া কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, সিনথেটিক বায়োলজির মতো নানা নতুন প্রযুক্তি ও অনেক সম্ভাবনাময় উদ্যোগের ক্ষেত্রে মুনাফা কম। উদ্যোক্তাদের জন্য তাই অর্থ বাঁচানো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ছাড়া ওই এলাকার ট্রাফিক জ্যাম ও বৈষম্যের বিষয়টিও উদ্যোক্তাদের বিবেচনায় রাখতে হয়।

সিলিকন ভ্যালির খরচ, বৈষম্য আর সুযোগ-সুবিধাগুলোর বিবেচনায় নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তাঁরা ছুটছেন অন্য শহরের দিকে, যেখানে খরচ তুলনামূলকভাবে কম আর ব্যবসায়িক সুবিধা বেশি। উদ্যোগ নজরদারির অলাভজনক প্রতিষ্ঠান দ্য কফম্যান ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, মায়ামি-ফোর্ট লডারডেল এখন নতুন স্টার্টআপদের পছন্দের জায়গা। এর বাইরে লস অ্যাঞ্জেলেসও প্রযুক্তি উদ্যোগের সক্রিয় শহর। পিটার থায়েল সেখানে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

অটোনোমাস বা স্বয়ংক্রিয় গাড়ি উদ্যোক্তাদের পছন্দ ফিনিক্স ও পিটসবার্গ এলাকা। মিডিয়া স্টার্টআপদের পছন্দ নিউইয়র্ক, ফিনটেকের জন্য লন্ডন, হার্ডওয়্যারের জন্য শেনঝেন। অবশ্য এ শহরগুলো কোনোটাকেই সিলিকন ভ্যালির সঙ্গে মেলানো যাবে না। কোন উদ্ভাবন কোন এলাকায় বেশি ছড়িয়ে পড়ছে, তার ভিত্তিতেই এ এলাকাগুলো উদ্যোক্তাদের পছন্দসই জায়গা হয়ে উঠছে।

বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, দারুণ সব আইডিয়া অনেক জায়গায় উঠে এলে তাকে স্বাগত জানাতেই হবে। উদ্ভাবনের ক্ষেত্র বা এলাকায় সমতার কথাটাও ভাবতে হবে। শুধু ক্যালিফোর্নিয়া নয়, প্রযুক্তি খাতের বিনিয়োগকারীরা বিশ্বজুড়ে ভালো ধারণার জন্য হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছেন। কোনো একটি অঞ্চল প্রযুক্তির কেন্দ্র হয়ে উঠবে এটা ভাবার কারণ নেই। সিলিকন ভ্যালির তৈরি করা প্রযুক্তির কল্যাণেই তা সম্ভব। স্মার্টফোন, ভিডিও কল বা মেসেজিং অ্যাপ দিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে দ্রুত কাজ ও যোগাযোগ করা সম্ভব। সিলিকন ভ্যালি অনেক কিছু ভালোভাবে করেছে। কিন্তু অভিযোগ আছে শেষ পর্যন্ত কিছু শ্বেতাঙ্গ পুরুষের একক ক্ষেত্রের মতো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। নারীদের প্রতিষ্ঠা করা প্রতিষ্ঠান মাত্র ২ শতাংশ বিনিয়োগ পেয়েছে সেখানে।

সিলিকন ভ্যালির আরেকটি সমস্যা হচ্ছে উদ্ভাবনের বিস্তৃতি সমান করে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে টেক জায়ান্টদের আধিপত্য। স্টার্টআপ বিশেষ করে ইন্টারনেট গ্রাহক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত উদ্যোগগুলো অ্যালফাবেট, অ্যাপল, ফেসবুকের আড়ালে বিনিয়োগ টানতে ব্যর্থ হচ্ছে। ২০১৭ সালে প্রথম বিনিয়োগ পাওয়ার হার ২০১২ সালের তুলনায় ২২ শতাংশ কমেছে। অ্যাপল ও ফেসবুক তাদের কর্মীদের এত বেতন দেয় যে নতুন উদ্যোগগুলো প্রতিভাবান কর্মী টানতে পারছে না। চীনেও আলিবাবা, বাইদু ও টেনসেন্টের আড়ালে পড়ে যাচ্ছে উদ্যোক্তারা।

এ ছাড়া পশ্চিমা নীতিগুলোও উদ্যোক্তাদের সিলিকন ভ্যালি ছাড়তে বাধ্য করছে। সেখানে অভিবাসনবিরোধী আবেগ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের করা ভিসা কড়াকড়িতে অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। বিদেশি উদ্যোক্তারা যুক্তরাষ্ট্রে ২৫ শতাংশ নতুন কোম্পানি খোলেন। কিন্তু এখন সেখান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তহবিল কমানো হয়েছে।

বৈশ্বিক ধারা বজায় রেখে যদি সিলিকন ভ্যালি থেকে উদ্যোক্তারা সরে যেতে থাকেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী টেক হাবগুলো বাড়তে থাকে, তবে তা আনন্দের কথা। অন্য কোথাও উদ্ভাবন কঠিন হয়ে দাঁড়ালে আর সিলিকন ভ্যালি আরও শক্তিশালী হলে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।