স্মার্টফোনে আসক্তি কেন? প্রতিকার কী?

কম্পিউটারের প্রায় সব কাজই মুঠোয় পুরে ফেলেছে স্মার্টফোন। বিশেষ করে পৃথিবীর অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই যন্ত্র। প্রথম আলো ফাইল ছবি
কম্পিউটারের প্রায় সব কাজই মুঠোয় পুরে ফেলেছে স্মার্টফোন। বিশেষ করে পৃথিবীর অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই যন্ত্র। প্রথম আলো ফাইল ছবি

রেগে টং হয়ে আছেন শ্রাবণী (ছদ্মনাম)। তাঁর পাশে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বসে থাকা রাতুল প্রেয়সীর মান ভাঙানোর উপায় নিয়ে চিন্তিত। শ্রাবণীর অভিযোগ, অফিস থেকে ফেরার পর সংসারের কাজ ফেলে স্মার্টফোনেই বেশি সময় কাটান তাঁর স্বামী। বারবার বলেও ফেরানো যায় না তাঁকে। এ নিয়েই হয়েছে ধুন্ধুমার ঝগড়া। সংসার বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমে রাতুল ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, কীভাবে স্মার্টফোনটিকে দূরে রাখা যায়!

স্মার্টফোন নিয়ে এমন ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতি এখন হরহামেশাই ঘটছে। স্মার্টফোনের প্রতি এই নিঃশর্ত ভালোবাসাকে প্রচলিতভাবে বলা হচ্ছে স্মার্টফোনে আসক্তি। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো স্মার্টফোনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাকে ‘আসক্তি’ বা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এ ধরনের আসক্তির মূল কারণ ইন্টারনেট, স্মার্টফোন নয়। তবে এ নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০৭ সালে উন্নত ফিচার নিয়ে বাজারে আসে আইফোন। এরপর থেকেই বিশ্বজুড়ে স্মার্টফোনের জয়যাত্রা শুরু। ২০১৮ সালে এসে এমন অবস্থা হয়েছে যে স্মার্টফোন যাঁর নেই তাঁর দিকেই সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকান! এক হিসাবে দেখা গেছে, গত বছর বিশ্বজুড়ে স্মার্টফোনের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২৩০ কোটি। চলতি বছরে এই সংখ্যা কমে যাবে, তা ভাবার কোনো যুক্তি নেই। কারণ, কম্পিউটারের প্রায় সব কাজই মুঠোয় পুরে ফেলেছে স্মার্টফোন। বিশেষ করে পৃথিবীর অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই যন্ত্র।

আলোর নিচেই অন্ধকার থাকে। স্মার্টফোন ব্যবহারের কিছু অপরকারিতাও আছে। সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাবটি পড়ছে মানুষের মনোজগতে। স্মার্টফোনে সময় কাটানোর হার বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে। তাতেই ঘটছে বিপত্তি। স্মার্টফোনে অত্যধিক নির্ভরশীলতা মানুষকে টেনে নিচ্ছে আসক্তির দিকে। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে জরুরি কাজ শিকেয় তুলে স্মার্টফোনের পর্দায় তাকিয়ে থাকছেন অনেকে।

সাম্প্রতিক বিভিন্ন হিসাবে বলা হচ্ছে, গড়ে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় স্মার্টফোনে খরচ করেন, এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। স্মার্টফোনে আসক্তি আদৌ সত্যি কি না, সেই বিষয়েও পুরোপুরি মনস্থির করতে পারেননি মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। তবে এটি যে নিত্যদিনের কাজে ছন্দপতনে ভূমিকা রাখছে, সেটি মানতে আপত্তি নেই কারও।

ইন্টারনেট নাকি স্মার্টফোন, কে অপরাধী?
অন্তর্জালের দুয়ার খোলার কিছুদিন পরই এতে আসক্ত হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিম্বারলি ইয়ং নামের একজন মনোরোগবিদ ১৯৯৫ সালে সেন্টার ফর ইন্টারনেট অ্যাডিকশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোনটি মানসিক রোগ, কোনটি নয়, সে বিষয়ে জানায় ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিসঅর্ডারস (ডিএসএম)। ইন্টারনেটভিত্তিক ভার্চুয়াল খেলাকে এতে অন্তর্ভুক্ত করেছে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন। ২০১৩ সালে বলা হয়, এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।

একই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটির ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অব ডিজিজে (আইসিডি) ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ইন্টারনেটের ব্যবহার এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে খেলা (গেমিং) দৈনন্দিন জীবনে কী ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করছে, তারও উল্লেখ আছে এতে। কিন্তু স্মার্টফোন নিয়ে কথা ওঠেনি কোথাও। স্মার্ট ডিভাইসের পরিবর্তে মানুষের আচরণগত পরিবর্তনকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

ইয়েল স্কুল অব মেডিসিনের সাইকিয়াট্রি ও নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক মার্ক পোটেনজা বলছেন, ইন্টারনেটে আসক্তি—এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক আছে। এ ক্ষেত্রে মানুষের আচরণের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ডেলিভারি ডিভাইসে (যেমন স্মার্টফোন) নয়।

তাই কখনো যদি মনে হয়, স্মার্টফোন ছাড়া জীবন অসহনীয়, তবে মনোরোগবিদেরা কাঠগড়ায় দাঁড় করান ইন্টারনেটকে। কারণ, ইন্টারনেটের কারণেই স্মার্টফোনটি স্মার্ট হয়েছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, স্মার্টফোনে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেশি হয়। যদি কেউ অনলাইনে গেম খেলতে চান, তখন কিন্তু স্মার্টফোন বা কম্পিউটারেই খেলা হয়। স্মার্টফোন বা কম্পিউটারকে হয়তো আসক্তির কারণ বলা হচ্ছে না, কিন্তু এগুলোতেই ইন্টারনেটের ব্যবহার বেশি হয়।

মেখলা সরকার আরও বলেন, ‘স্মার্টফোন আসক্তি সৃষ্টিকারী একটি যন্ত্র। এটি এমনভাবেই বানানো হয় যেন সব সময় এটি নাড়াচাড়া করতে ইচ্ছে জাগে। এখনো হয়তো স্মার্টফোনের বিষয়টি আসক্তি হিসেবে ধরা হচ্ছে না। কিন্তু ইন্টারনেট বা গেমিংয়ে আসক্তি—দুটোই সবচেয়ে সহজে হয় স্মার্টফোনের মাধ্যমে। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’

স্মার্টফোন ব্যবহারের কিছু অপরকারিতাও আছে। সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাবটি পড়ছে মানুষের মনোজগতে। স্মার্টফোনে অত্যধিক নির্ভরশীলতা মানুষকে টেনে নিচ্ছে আসক্তির দিকে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
স্মার্টফোন ব্যবহারের কিছু অপরকারিতাও আছে। সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাবটি পড়ছে মানুষের মনোজগতে। স্মার্টফোনে অত্যধিক নির্ভরশীলতা মানুষকে টেনে নিচ্ছে আসক্তির দিকে। প্রথম আলো ফাইল ছবি

স্মার্টফোনে আসক্তি কেন?
অভ্যাস ও আসক্তিকে অনেকে গুলিয়ে ফেলেন। দুটো এক নয়। আসক্তির বিষয়টি ভিন্ন। এটি এমন নির্ভরশীলতা তৈরি করে, যা থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও তাঁর অবচেতন মন তাতে বাধা দেয়। মাদকাসক্তির মতোই অন্য যেকোনো আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়া সময়সাপেক্ষ বিষয়।

কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, মানুষের পুরস্কার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বা আচরণ (রিওয়ার্ড মোটিভেটেড বিহেভিয়র) থেকে স্মার্টফোনে আসক্তি হয়ে থাকতে পারে। মানবমস্তিষ্কে ডোপামিন নামক এক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণের কারণে এ ধরনের আচরণ দেখা দেয়। ডোপামিন একধরনের নিউরোট্রান্সমিটার। এটি মানুষের পুরস্কার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অন্য স্তন্যপায়ীদের তুলনায় মানুষে ডোপামিনের মাত্রা বেশি। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে চায়। সেখান থেকেই জন্ম নেয় পুরস্কার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বা আচরণ। এই সবকিছুর জন্যই স্মার্টফোন দেখা হয় ঘন ঘন, বাড়ে আসক্তি।

তবে এই ধারণা এখনো সব গবেষণায় সার্বিকভাবে প্রমাণিত হয়নি বলে জানান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার। তিনি বলেন, কিছু কিছু গবেষণায় এটি দেখা গেছে। ইন্টারনেট বা গেম না থাকলেও কোনো মানুষের স্মার্টফোনে আসক্তি দেখা দিচ্ছে কি না, সেটি নিয়ে গবেষণা হলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

আসক্তি কখন?
দিনে ঠিক কতক্ষণ স্মার্টফোন ব্যবহার করলে, তাকে আসক্তি বলা যাবে, সেটি এখনো নির্দিষ্ট হয়নি। কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে, গড়ে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করলে, তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছায়। তবে এটি সর্বজনগ্রাহ্য নয়। গবেষণা জার্নাল প্লস ওয়ানে ২০১৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, স্মার্টফোন হাতের নাগালে না থাকলে একজন ব্যবহারকারী কেমন আচরণ করছেন, তা থেকেই বোঝা যাবে স্মার্টফোনে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার বিষয়টি।

মনোরোগবিদ মেখলা সরকার বলছেন, আসক্তির সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা দিতে হবে। একজন ব্যক্তি যদি ক্রমাগত স্মার্টফোন ব্যবহারের সময় বাড়াতে থাকেন এবং স্মার্টফোন ব্যবহার না করলে অস্থিরবোধ করতে থাকেন বা অনিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া দেখান, তখন বলা যাবে যে এটি আসক্তির দিকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ব্যক্তির নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে রেখেও হয়তো তিনি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে থাকবেন এবং তা বোঝার পর চেষ্টা সত্ত্বেও স্মার্টফোন থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না।

মুক্তি কিসে?
স্মার্টফোনে আসক্তির বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করছে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাপল জানিয়েছে, আইফোনে সময় কাটানোর হার জানাতে নতুন ফিচার আনা হয়েছে। এই নতুন অ্যাপ ব্যবহারকারীদের নিয়মিত জানাবে যে আইফোনে দিনে ঠিক কতক্ষণ সময় কাটাচ্ছেন ব্যবহারকারীরা। শুধু আইফোন নয়, একই ধরনের অ্যাপ এসেছে অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মেও।

মেখলা সরকার বলছেন, স্মার্টফোনে আসক্তি দেখা দিলে হুট করে তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। কারণ, প্রাত্যহিক জীবনের নানা জরুরি কাজের সঙ্গে স্মার্টফোন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্মার্টফোন বাদ দিয়ে আগের ফিচার ফোনে চলে যাওয়া যায়। ইন্টারনেট ব্যবহারের যন্ত্র হিসেবে স্মার্টফোনের ব্যবহার বন্ধ করে কম্পিউটারে যেতে পারে। এ ছাড়া স্মার্টফোন ব্যবহার চালু রেখেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের অ্যাপস বা গেমিং অ্যাপস আনইনস্টল করা যায়। এভাবে উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ এনে আসক্তি দূর করা যায়। এক কথায়, স্মার্টফোনের এন্তার সুবিধা কমিয়ে আনতে হবে।’

এর পাশাপাশি পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এই মনোরোগবিদ। মেখলা বলেন, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভার্চুয়াল জগতের বদলে বাস্তব জীবনে সময় কাটাতে হবে।

অর্থাৎ কল্পনার জগৎ থেকে নেমে আসতে হবে বাস্তবের ধুলো-কাদার পৃথিবীতে। মোবাইল স্ক্রিনে নয়, হাতে ছুঁয়ে স্পর্শ করতে হবে পাপড়ি মেলে ধরা সত্যিকারের ফুল। তবেই স্মার্টফোন ব্যবহারের বাড়াবাড়ি থেকে মিলবে রেহাই।