অন্তরে অন্তর্জালে

মডেল: সারা, ছবি: সুমন ইউসুফ
মডেল: সারা, ছবি: সুমন ইউসুফ
>

পতাকার লাল–সবুজ দেখা যায় ফেসবুকের পাতায় পাতায়, অন্তর্জালের নানা মাধ্যমে। অন্তরের দেশপ্রেমের প্রকাশের বড় মাধ্যম এখন প্রযুক্তি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা রকম কাজও হচ্ছে এখন অনলাইনকেন্দ্রিক। সত্যিকারের ‘মুক্তির সংগ্রাম’ যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে, তার মাধ্যমও হতে পারে প্রযুক্তি।

‘তোমরা তো দেখি সব পাগল!’ বিল ওয়েস্টারম্যান নামে আমার এক ভিনদেশি বন্ধু একবার আমাকে বলেছিল এ কথা। এক আমেরিকান পুরো ১৬ কোটি মানুষকে পাগল বলছে, এটা দেখে রাগ করারই কথা। রাগ হয়নি, বিলের পরের বাক্যটার কারণে: ‘আই লাভ ইউর ম্যাডনেস!’
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করার সুবাদে বিলের বন্ধুতালিকায় নানা দেশের মানুষের সংযোগ। কিন্তু দেশ নিয়ে আবেগের প্রকাশে এমন পাগলামি বিল কোথাও দেখেননি। আমার যত বিদেশি বন্ধুকেই এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতে দেখি, তাদের লন্ডন টাইমস উদ্ধৃত কথাটা আরেকবার শুনিয়ে দিই—রক্তই যদি স্বাধীনতার মূল্য হয়, ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দাম শোধ করেছে বাংলাদেশ।

বিলদের তাই বুঝিয়ে বলতে হয়, আর সব দেশের চেয়ে আমাদের পার্থক্য হলো, আমাদের স্বাধীনতা দিবস আছে, আছে বিজয় দিবসও। আর মাঝখানে আছে দেশ মায়ের নয় মাসের তীব্র গর্ভযন্ত্রণা!

আর আমাদের আছে ভাষা দিবসও। যে দিনটা এখন আমরা পৃথিবীর সব মানুষকে দিয়েছি। নিজের মায়ের মুখের ভাষায় কথা বলার অধিকার। ভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছে, এমন জাতিও তো খুব বেশি নেই। বিলরা বুঝে নেয়, কেন আমাদের জাতীয় পতাকায় সবুজের প্রেক্ষাপটে ওই লাল টকটকে সূর্যটা!

আর এ কারণেই আমাদের এই তিনটি জাতীয় দিবস এলে আমরা এতটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি, আবেগের সেই উত্তুঙ্গ স্রোত আশপাশেও গিয়ে প্রবল ধাক্কা দেয়। এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, বিশেষ কোনো দিবসে বাংলাদেশের ভার্চ্যুয়াল জগতের রং হয়ে যায় লাল-সবুজ। ফেসবুকে সবার প্রোফাইল ছবিতে এই দুই রং।

বিজয় দিবসের মতো দিনে এমন সেলফি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। মডেল:  কাব্য
বিজয় দিবসের মতো দিনে এমন সেলফি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। মডেল: কাব্য

আরও একবার বিজয় দিবস দুয়ারে। এখনই বদলাতে শুরু করেছে অনেকের প্রোফাইল কি কাভার ফটো। আগামী কয়েক দিন আমাদের সবাইকে সহ্য করতে হবে যন্ত্রণা, ভালোবাসার যন্ত্রণা। দেশের কত গান আর কবিতার চরণ উঠে আসবে সামাজিক মাধ্যমে! বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন। আগামী কদিনে ফেসবুক হয়ে উঠবে বাংলাদেশের হৃদয়!
তবে আসল জাদুটা এখানেই শেষ নয়। কারও কারও কাছে প্রতিটা দিনই বিজয় দিবস। কারও কাছে প্রতিটা মুহূর্তই স্বাধীনতা দিবসের চেতনার লড়াই। কারও কারও কাছে, যুদ্ধ শেষ হয়নি এখনো। কিছু খ্যাপা তরুণকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। যাদের ‘পাগলামি’ দেখে আমরাই অবাক হয়ে যাই।

বেশ কয়েক বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণিক দলিল নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছিল। লাইব্রেরিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ওঠাতে আর নামাতে গিয়েই কাহিল হওয়ার দশা। ১৫ হাজার পৃষ্ঠায় ধরা আছে আমাদের মহান যুদ্ধের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, প্রামাণিক দলিল।

সেই ১৫ খণ্ডের দলিলপত্র পুরোটাই ডিজিটাল আর্কাইভে তোলার ব্যবস্থা করছেন কিছু তরুণ। স্বেচ্ছাশ্রমে সেই দলিলপত্র লেখার কাজ করছেন তাঁরা। সেগুলো তোলা হচ্ছে তাঁদের ফেসবুক পেজে। যেহেতু ফেসবুকেই এখন তরুণদের বিচরণ বেশি। তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের এই গল্পগুলো তুলে ধরাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য।

নাজমুল হাসান নামের এক তরুণের নেতৃত্বে এক কাজে যুক্ত আছেন ৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবক। যুদ্ধদলিল নামের এই প্রকল্পের পরিধি দিন দিন বাড়ছে। একটি ওয়েবসাইট করা হয়েছে, যেখানে ইউনিকোডে লেখা পুরো দলিল তুলে দেওয়া হয়েছে। বানানো হয়েছে অ্যাপ। ফ্লিকারের মতো ছবি সংরক্ষণের সাইটে জমা করা হচ্ছে বড় রেজল্যুশনে মুক্তিযুদ্ধের সব ছবি।
এ তো গেল ইতিহাস। আর বর্তমান? এ নিয়েও কাজ করছেন অসংখ্য তরুণ। গড়ে উঠেছে অজস্র স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। এগুলোও মূলত সংগঠিত হয়েছে অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে। পরে কাজটি তারা নিয়ে গেছে অফলাইনে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘লাইটার’ নামের সংগঠনটির কথা। যারা কাজ করছে যুদ্ধাহত অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। এই মুক্তিযোদ্ধাদের কাউকে তারা বাড়ি বানিয়ে দেয়, কারও জন্য গড়ে দেয় দোকান। কারও সন্তানের পড়াশোনার ভার নেয়। এই সংগঠনের আরও একটি বড় কার্যক্রম হলো যে স্কুলে শহীদ মিনার নেই, সেখানে শহীদ মিনার বানিয়ে দেওয়া।

রুরাল এডুকেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (রেড) নামের আরও একটি সংগঠন আছে, যারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ছোট পরিসরে শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে বানানো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বইটি বিনা মূল্যে বিতরণ করে।

এমন অসংখ্য কাজ হচ্ছে, যাঁদের কাজের বড় অংশই হয় অনলাইনে। সংগঠিত হওয়া, নিজেদের কাজগুলো অন্যের কাছে তুলে ধরা, অনেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাহায্যে বিভিন্ন প্রকল্পের বাজেট গড়ে তোলা।

শুধু তো অতীত বা বর্তমান নয়; কাজ করতে হবে ভবিষ্যৎকে লক্ষ্য করেও। ওই যে, যুদ্ধটা তো এখনো শেষ হয়নি। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। সেই মুক্তি তো অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতায়। সারা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোয়।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তরুণদের এই যে সীমাহীন উৎসাহ, সেটিকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগিয়ে এই মুক্তির পথে যাত্রা শুরু করা যায়। এমনটাই করে দেখিয়েছিলেন বেসিসের (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস) সাবেক সভাপতি শামীম আহসান। ২০১৩ সালে বেসিসের পক্ষ থেকে তিনি ‘ওয়ান বাংলাদেশ ভিশন’ নামের একটি স্বপ্নযাত্রার কথা বলেছিলেন। তাতে লক্ষ্য ছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এক বিলিয়ন ডলার আয় করবে। ১০ লাখ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। জিডিপিতে এই খাত ১ শতাংশ অবদান রাখবে।

এই ভিশনের অনেক কিছুই পূরণ হয়েছে, কিছু লক্ষ্য এক-দুই বছরের মধ্যে পূরণ হবে। তবে এই কাজ করতে গিয়ে শামীম আহসান আবিষ্কার করেছেন, অপার সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের, যা বাংলাদেশ হয়তো নিজেও জানে না।

শামীম মনে করেন, ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছে সেই দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত। ভারতের বেঙ্গালুরু বা হায়দরাবাদ হয়ে উঠেছে নতুন সিলিকন ভ্যালি। সেই সম্ভাবনা বাংলাদেশেরও আছে। বিশ্বের কাছে ‘বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং’ করে তুলে ধরতে হবে, এই দেশটাই পরবর্তী ‘আইটি ডেস্টিনেশন’।

এই সম্ভাবনা পূরণ করতে তিনি দুটি দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। এক বিলিয়ন ডলার আয় করতে চাইলে প্রচারণায় অন্তত দুই মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। বিশ্বের বড় বড় আইটি প্রতিষ্ঠানের মনোযোগ বাংলাদেশের দিকে ফেরাতে হবে। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে জরুরি হলো, দেশপ্রেমে টইটম্বুর বাংলাদেশের এই যে প্রযুক্তি-উৎসাহী প্রজন্ম, তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে আগামীর জন্য গড়ে তোলা। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত কিছু পরিবর্তন আনা, যেন এই খাতে বিশ্বজুড়ে যে বিশাল চাহিদা তৈরি হয়েছে, তাতে অংশ নিতে পারে বাংলাদেশের জনশক্তি। কেবল বাংলাদেশ থেকেই প্রতিবছর দুই বিলিয়ন ডলারের কাজ বিদেশিরা নিয়ে যাচ্ছে। এমন দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে, যেন এই কাজটা বাংলাদেশের তরুণেরাই করতে পারে। তাহলেও তো রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ আয় যুক্ত করা যাবে।

আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড নির্মাণ করেছে শ্রমনির্ভর জনশক্তি। আমাদের প্রবাসী, আমাদের পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা। এখন মেধানির্ভর জনশক্তিকে এগিয়ে আনার এটাই সবচেয়ে সেরা সময়।
আমাদের অতীত আছে, আছে বর্তমানও। এখন চলছে ভবিষ্যৎ নির্মাণের পালা।

মুক্তিযুদ্ধকে আরও ভালো করে জানতে সাহায্য করবে যেসব ওয়েবসাইট
● মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওয়েবসাইট
www.liberationwarmuseum.org
● ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র থেকে বলছি
www.facebook.com/muktizuddho1971
● মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ১৫ খণ্ডের দলিলপত্রের ডিজিটাল আর্কাইভ
www.juddhodolil.com
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়
www.molwa.gov.bd
● গণহত্যার প্রামাণ্য দলিল নিয়ে ওয়েবসাইট
www.genocidebangladesh.org
● মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জনপ্রিয় গেম
হিরোজ অব ৭১ (মিলবে গুগল প্লে স্টোরে)
● মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অ্যাপ
মুক্তিযুদ্ধ, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, ৭১
ইউটিউবে মিলবে চলচ্চিত্র
মুক্তির গান, আগুনের পরশমণি, চিলড্রেন অব ওয়ার ইত্যাদি।