ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ কতটা গভীর

মানুষ দিন দিন অনলাইন যোগাযোগে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। মডেল: সায়রা। ছবি: স্মার্ট সময়
মানুষ দিন দিন অনলাইন যোগাযোগে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। মডেল: সায়রা। ছবি: স্মার্ট সময়

 ‘হঠাৎ রাস্তায় অফিস অঞ্চলে, হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে, বন্ধু কী খবর বল? কত দিন দেখা হয়নি’—এই গানের মতো এমনটা প্রায়ই এখন মানুষের জীবনে ঘটে, তবে সেটা অফিসপাড়ায় নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ১০ বছরের পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে ফেসবুকে দেখা, আবার বছরের পর বছর ধরে বন্ধু তালিকায় থাকার পরও কোনো দিন দেখা হয়নি—ভার্চ্যুয়াল জগতের হরহামেশার গল্প এগুলো।

আসলে যোগাযোগপ্রযুক্তির উন্নয়নের সুবাদে মানুষ এক নতুন জগতের স্বাদ পাচ্ছে। এর নাম ভার্চ্যুয়াল জগৎ। বাস্তব জগতের সঙ্গে সঙ্গে এ জগৎও এগিয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। বাস্তবের চেয়ে এ জগৎ বেশি গতিময়। ইন্টারনেটকেন্দ্রিক এ জগতে কোনো ধরাবাঁধা সময় নেই। রাত-দিনের বিভাজন নেই। এই ভার্চ্যুয়াল জগৎ স্থান ও সময়ের প্রচলিত ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। কয়েক ইঞ্চির মোবাইল ফোন আর কম্পিউটারের মনিটরে মানুষ ধীরে ধীরে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে, কখনো বাস্তব, কখনো অবাস্তব, কিছু সত্য, কিছু মিথ্যা সম্পর্ক গড়ে তুলতে।

বাস্তবে হয়তো একটি মানুষের কোনো বন্ধুই নেই, কিন্তু ভার্চ্যুয়াল জগতে সে খুবই আনন্দের ও কোলাহলপূর্ণ জীবনযাপন করছে। কারও সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠছে, আবার তা দ্রুত ভেঙেও যাচ্ছে। কেউ কেউ একই ছাদের নিচে বসবাস করে সামনাসামনি কথা না বলে ইন্টারনেটে বার্তা দিয়ে কথা বলছে, আবার কেউ ভার্চ্যুয়াল জগতের সঙ্গে বাস্তবকে মিলিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। মানুষে মানুষে একটা মোহমায়ার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে।

বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকে বন্ধুত্বের গভীরতা নিয়ে গবেষণা চালান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ওই অধ্যাপক রবিন ডানবার ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সের ৩ হাজার ৩৭৫ জন ফেসবুক ব্যবহারকারীর ওপর তাঁর গবেষণাটি চালান। গড়ে এই ব্যবহারকারীদের দেড় শ ফেসবুক বন্ধু আছে। দেখা গেছে এর মধ্যে গড়ে মাত্র ৪ দশমিক ১ জনের ওপর ভরসা করেন একজন ব্যবহারকারী। এ ছাড়া দুঃখের দিনে কেবল সমবেদনা প্রকাশ করেন ১৩ দশমিক ৬ জন। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, একজন ব্যবহারকারীর ফেসবুকে হয়তো বিশাল এক বন্ধু তালিকা আছে। তবে বাস্তবে নিকট বন্ধুর সংখ্যা তাঁর অনেক কম, আর সংখ্যা বাড়াতে আগ্রহীও নন তিনি। তরুণ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বন্ধুর সংখ্যা অনেক বেশি অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ফেসবুক ব্যবহারকারীর তুলনায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব ভালো একটি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন শান্তা। ফেসবুক ব্যবহার করেন বেশ অনেক দিন ধরেই। একদিন এক ব্যক্তি তাঁকে বন্ধু হওয়ার আবেদন পাঠান। মুখটা বেশ চেনা চেনা। ওই ব্যক্তির প্রোফাইল ঘেঁটে দেখেন তথ্য দেওয়া আছে ঢাকা মেডিকেলে এমবিবিএস করছেন। শান্তার মনে হলো হয়তো কখনো কথা হয়েছে, চেনেন তিনি। বন্ধু বানিয়ে ফেলেন। কিছুদিন পরে টের পান পাড়ার মুদির দোকানদার ওই ব্যক্তি। এসএসএসির গণ্ডি পেরিয়েছে কি না, তা নিয়েই সংশয় আছে। আর এ জন্যই মুখটা চেনা চেনা লেগেছিল।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাফায়েত আহমেদের পারিবারিক ছবি সবার মনে বেশ ঈর্ষা জাগায়। কী সুখী! দুই সন্তান নিয়ে কী চমৎকার একটি সংসার। তবে তাঁর বাস্তবজীবনের একান্ত বন্ধুরাই জানেন পরিবারের প্রতি কতটা অবহেলা করেন তিনি। তেমনি ঘটেছে মাইশার ক্ষেত্রে। ১৫ বছরের পুরোনো স্কুল সহপাঠী ফেসবুকে বন্ধু, অথচ সামনাসামনি দেখা হলে কথাও বলেন না। সামনাসামনি পছন্দ করেন না, অথচ ফেসবুকে সাফল্য দেখে ‘এগিয়ে যাও বন্ধু’ মন্তব্য করছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এমনটাও দেখা যায়, বাবার অবৈধ কাজে বিব্রত অথচ ফেসবুকে লিখছেন ‘আমার আদর্শ বাবা’। আবার সামান্য ঘটনা নিয়ে বিবাদ থেকে প্রিয় বন্ধুকে বন্ধুতালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন অনেকে।

ভার্চ্যুয়াল জগতে প্রতারণার গল্পও কম নয়। বায়বীয় এ জগতে চলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা। মাত্র কয়েক দিন আগেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে একটি মেয়ের গল্প। কলেজে পড়া মেয়েটির সঙ্গে ফেসবুকে ভুয়া আইডির এক ছেলের প্রেম হয়। একটানা দেড় বছর কথা হয় ফেসবুকে। এর মধ্যে দেখা হয় না তাদের। একদিন ছেলেটা জানায়, সে খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। প্রেমের টানে মেয়েটি একা কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে ছুটে যায়। সেখানে গিয়েই গিয়ে বুঝতে পারে কত বড় প্রতারণার শিকার সে। ভার্চ্যুয়াল সম্পর্ক আসলে অবাস্তব আবেগে ঘেরা একটি ঠুনকো সম্পর্ক। ক্ষণস্থায়ী এ সম্পর্কের ঘোর কেটে গেলে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়, তার মোকাবিলা করা অনেক ক্ষেত্রেই মুশকিল হয়ে পড়ে।

বন্ধু শব্দের ব্যাপ্তি অনেক। ফেসবুক জগতে বন্ধু, ইনস্টাগ্রামে অনুসারীর ছড়াছড়ি। তবে এ সম্পর্কের গভীরতা আসলে কতটুকু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই বন্ধু আসলে কতটা বন্ধু? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা মোসতাফা খানম বলেন, ভার্চ্যুয়াল জগৎ আমাদের স্বাভাবিক সামাজিক বন্ধনে অনেকটা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। অসুস্থ মানসিকতার প্রকাশ পাচ্ছে। আমাদের নেশাগ্রস্ত করে তুলছে। দেখা গেছে মা অসুস্থ হয়ে পাশের ঘরে কাতরাচ্ছেন, অন্য ঘরে বসে সন্তান ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে ‘মা অসুস্থ, খুব খারাপ লাগছে’। অথচ মাকে সাহায্য করতে সে এগিয়ে যাচ্ছে না। ভার্চ্যুয়াল জগতে কাছে থাকলেও বাস্তব জগতে এক বিশাল দূরত্ব মা-সন্তানের সম্পর্কে। আসলে আমি হিসেবে আমাকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভার্চ্যুয়াল জগৎকে বেছে নিচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ, যা স্থূল রুচির পরিচয়।

ভার্চ্যুয়াল জগতের ইতিবাচক প্রভাব পেতে হলে কীভাবে এর ব্যবহার করব, তা নিয়ে ভাবতে হবে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, আমরা কিন্তু ভার্চ্যুয়াল জগতের ভালো দিক দেখেছি। আরব বসন্ত হয়েছে এই ভার্চ্যুয়াল জগতের কারণে। অনেক সময় আমরা দেখি ফেসবুকের এক দল বন্ধু দরিদ্র মানুষের সেবায় কাজ করছে, রক্তদান কর্মসূচিতে এগিয়ে আসছে। যা দেখে অন্যরাও মানুষকে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। দূরের মানুষকে কাছে এনে দিচ্ছে। এই সম্পর্ক কিন্তু এই ভার্চ্যুয়াল জগতের জন্যই তৈরি হচ্ছে। তাই এটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। শুরু থেকে সন্তানকে এই ভার্চ্যুয়াল জগতের ব্যবহার বোঝাতে হবে অভিভাবকদের।