কল্পকাহিনি থেকে বাস্তবের পথে

নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন মানুষের জীবনধারাকে বদলে দিয়েছে। গবেষকেরা মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গেও আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তি যুক্ত করার পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই মানুষের মস্তিষ্কের অনেক তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে তা টাইপ করার মতো উন্নত যন্ত্রও চলে আসবে। এ ধরনের যন্ত্র তৈরি হলে মানুষের অনেক উপকার হবে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। ফেসবুক, গুগলের মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। মাহাকাশ প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী এলন মাস্ক এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অনেকদূর এগিয়েছেন।

এলন মাস্কের ‘নিউরালিংক’ নামে একটি নতুন উদ্যোগের (স্টার্টআপ) কথা ইতিমধ্যে অনেকের জানা হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটি মূলত কম্পিউটারের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্ক যুক্ত করার প্রযুক্তি তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি তথাকথিত ‘স্নায়ু লেস’ প্রযুক্তি বিকাশ করবে, যার মাধ্যমে মস্তিষ্কে ক্ষুদ্র ইলেকট্রোড স্থাপন করা যাবে। এই প্রযুক্তি স্মৃতিশক্তির উন্নতির জন্য ব্যবহার করা যাবে কিংবা মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যুক্ত করতে পারবে। এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ একাডেমিয়ানরা প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করার জন্য ইতিমধ্যেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা এমন একটি সময়ের কথা কল্পনা করছেন, যখন মানুষ তাঁদের চিন্তাভাবনা আপলোড ও ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। অর্থাৎ, মানুষের মস্তিষ্কে কম্পিউটার প্রতিস্থাপন করা গেলে তাঁর চিন্তাভাবনা আরেকজন পড়ে ফেলতে পারবেন।

মনের কথা পড়ার এমন যন্ত্র তৈরির বিষয়টি এখন আর কল্পকাহিনির মতো শোনায় না। বাস্তবেও এমন ধরনের যন্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন গবেষকেরা। ফেসবুকের গবেষকেরা এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়েছেন। তাঁরা ভবিষ্যতে এমন যন্ত্র তৈরির কথা ভাবছেন, যা মস্তিষ্ক ব্যবহার করে কোনো শব্দ টাইপ করা এবং তা বার্তা আকারে পাঠাতে পারবে। সম্প্রতি তাঁদের গবেষণার আশানুরূপ ফলাফল পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ফেসবুকের কর্মকর্তারা।

ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আসলে এমন এক ধরনের যন্ত্র তৈরি করতে চাইছে যাতে মানুষকে আর স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। অর্থাৎ, স্মার্টফোনের চেয়েও আধুনিক পণ্য তৈরির বিষয়ে এগিয়ে গেছেন গবেষকেরা। এ যন্ত্র মাথায় বসালেই কাজ হবে। ফেসবুকের পক্ষ থেকে অগমেন্টেড রিয়্যালিটি (এআর) গ্লাসসহ নানা পরিধানযোগ্য প্রযুক্তিপণ্য তৈরির সম্ভাবনার কথা বলছেন গবেষকেরা। এতে স্মার্টফোন ব্যবহার না করেও পরস্পরের সঙ্গে বাস্তবে যোগাযোগ করা যাবে।

ফেসবুকের এক ব্লগ পোস্টে বলা হয়, পরস্পরের সঙ্গে সহজে যোগাযোগে ক্ষেত্রে এআরের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এতে মানুষকে আর ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এ ছাড়া ল্যাপটপের দিকেও ঝুঁকে থাকতে হবে না। মানুষের চোখে চোখ রেখে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান–প্রদান করতে পারবে।

ফেসবুকের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে তাদের গবেষণা ল্যাব বিল্ডিং ৮–এর ঘোষণা দেওয়া হয়। সেখানে কম্পিউটার ব্রেইন ইন্টারফেস নিয়ে কাজ চলছে। ওই সময়ে ফেসবুকের কম্পিউটার ব্রেইন ইন্টারফেস প্রকল্পপ্রধান রেজিনা ডুগান বলেছিলেন, ফেসবুক একধরনের ‘সাইলেন্ট স্পিস সিস্টেম’ তৈরি করতে যাচ্ছে, যা মস্তিষ্ক থেকে সরাসরি মিনিটে ১০০ শব্দ টাইপ করতে পারবে। এটি একজন ফোনে যত শব্দ টাইপ করতে পারেন, তার চেয়ে দ্রুত কাজ করতে সক্ষম হবে।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা পৃথক গবেষণায় প্যারালাইজড রোগীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে সফল হয়েছেন। তবে তাঁদের গবেষণার ক্ষেত্রে রোগীর মস্তিষ্কে আলাদা করে ইলেকট্রোড বসানো লাগে। তবে ফেসবুকের গবেষকেরা বলছেন, তাঁদের গবেষণায় মাথায় যন্ত্র পরলেই যোগাযোগ করা যাবে। ফোসবুক তাদের গবেষণা আরও সামনে এগিয়ে নিলে কিছুদিনের মধ্যেই মস্তিষ্ক থেকে মস্তিষ্কে যোগাযোগের যন্ত্র পাবে মানুষ।

এর আগে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত টিভি ব্যবস্থা তৈরির কথা বলেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্যামসাং। সুইজারল্যান্ডের ইকোল পলিটেকনিক ফেডারেল ডি লোজেনের (ইপিএফএল) সঙ্গে মিলে পনথিয়াস প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠানটি গুরুতর শারীরিক অক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের অন্য কারও সাহায্য ছাড়াই তাদের পছন্দের অনুষ্ঠান উপভোগের সুযোগ দিতে এ উদ্যোগ নেয়। এই প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের সঙ্গে টিভির সংযোগ স্থাপন করতে একটি ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) ব্যবহার করার কথা বলা হয় যাতে ৬৪টি সেন্সরযুক্ত একটি হেডসেট এবং চোখের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য থাকে একটি আই-মোশন ট্র্যাকার।

মস্তিষ্ক এবং স্মৃতি ধরে রাখার বিষয়টাকে ‘ট্রান্সহিউম্যানিজম’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানীদের সাহায্যে মানবদেহকে তার বর্তমান রূপ থেকে অন্য রূপেও নেওয়া সম্ভব—এমন বিশ্বাসই ট্রান্সহিউম্যানিজম। মনের ভাবনাগুলোকে সরাসরি কম্পিউটারে আপলোড করার ধারণাটা যাঁরা ছড়িয়ে দিয়েছেন, গুগলের প্রকৌশল শাখার পরিচালক রে কার্জেইল তাঁদের অন্যতম, যিনি বিশ্বাস করেন ২০৪৫ সালের মধ্যে মানুষ তার সমগ্র মস্তিষ্ককেই কম্পিউটারে আপলোড করে ফেলতে সক্ষম হবে। ঠিক যেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো!

মাস্কের প্রতিষ্ঠান এখন এরকম প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। সর্বশেষ তারা ‘নিউরাল লেইস’ প্রযুক্তি বানিয়েছে। এটা সংকেত পরিমাপের জন্য মস্তিষ্কে একধরনের পরিবাহী বা তার বসাবে। সে জন্য শল্যচিকিৎসা দরকার। বর্তমান প্রযুক্তির নানা সীমাবদ্ধতার জন্য এই প্রকল্পকে অতি উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে। তবে প্রযুক্তি গবেষকেরা যুগান্তকারী সাফল্যের জন্য নিরলস কাজ করছেন।