হৃদরোগের চিকিৎসায় নতুন পথ

স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা করে কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবন করছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স
স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা করে কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবন করছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মারা যান। হৃদরোগীদের জন্য সুখবর হিসেবে এর কার্যকর চিকিৎসায় নতুন পথের সন্ধান দিলেন চীনের গবেষকেরা। তাঁরা স্টেম সেল বা ভ্রূণ কোষ ব্যবহার করে হৃদরোগের চিকিৎসা করে সফলতা পেয়েছেন। চীনের নানজিং ড্রাম টাওয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞরা গত বছর চীনের দুজন রোগীকে স্টেম সেল চিকিৎসা দেন। তাঁদের দাবি, এক বছর পরে রোগীরা ভালো আছেন। নতুন করে আরও ২০ জন রোগীর ক্ষেত্রে এ চিকিৎসা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে চীন সরকার।

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে প্রথমবারের মতো হৃদরোগের চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে ‘রিপ্রোগ্রামড স্টেম সেল’ বা বিশেষ প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত ভ্রূণ কোষ ব্যবহার করা হয়। দুজন ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়ার এক বছরের মাথায় তাঁরা পুরোপুরি সেরে উঠেছেন বলে দাবি করেছেন এ প্রক্রিয়া সম্পাদনকারী কার্ডিয়াক সার্জন। গত বছরের মে মাসে ইনডিউসড প্লুরিপোটেন্ট স্টেম (আইপিএস) থেকে সংগৃহীত হৃদপেশি কোষ ওই ব্যক্তিদের ইনজেকশন হিসেবে পুশ করা হয়। ওই সার্জন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত হৃদযন্ত্রের চিকিৎসায় এটাই বিশ্বে প্রথম আইপিএস-সেল প্রযুক্তির চিকিৎসা প্রয়োগের ঘটনা।

গবেষণাসংক্রান্ত ফলাফল এখনো কোনো সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়নি বলে অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, চিকিৎসাপদ্ধতি ঠিকমতো কাজ করেছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

নানজিং ড্রাম টাওয়ার হাসপাতালের সার্জন ওয়াং ডংজিন ‘নেচার’কে চিকিৎসাপদ্ধতি ও রোগীর পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন। রোগীদের মধ্যে একজনের নাম হান ডেওং, যাঁর বয়স ৫৫ বছর। পেশায় বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি হান হার্ট বাইপাসের পাশাপাশি এ চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। চিকিৎসা গ্রহণের আগে সব সময় ক্লান্তি ও দম আটকানোর পরিস্থিতি ছিল তাঁর। এখন তিনি হাঁটতে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে ও রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান অবস্থা আমার প্রত্যাশার বাইরে ছিল।’

গবেষণাকাজে যুক্ত নানজিংভিত্তিক জৈব প্রযুক্তি কোম্পানি ‘হেল্প থেরাপিউটিকস’-এর প্রধান নির্বাহী ওয়াং জিয়াশিয়ান বলেন, গবেষণাসংক্রান্ত ফলাফল এ বছরের শেষ নাগাদ প্রকাশ করবেন তাঁরা। হেল্প থেকে গবেষণাকাজে ব্যবহৃত ‘কার্ডিওমায়োসাইটস’ নামের হৃদপেশি কোষ সরবরাহ করা হয়েছিল। তাঁরা এখন গবেষণা বাড়ানোর অনুমতি পেয়েছেন।

অবশ্য আইপিএস কোষ ব্যবহার করে পরীক্ষামূলক চিকিৎসা চীনের পাশাপাশি জাপানেও শুরু হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে ইয়োশিকি সাওয়া নামের একজন কার্ডিয়াক সার্জন আইপিএস থেকে সংগৃহীত ‘কার্ডিওমায়োসাইটস’ ব্যবহার করে একজন রোগীর চিকিৎসা দেন, যা ওই সময়ে বিশ্বের প্রথম বলে গণমাধ্যমে উঠে আসে। তবে ইয়োশিকি অঙ্গে ইনজেকশনের পরিবর্তে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে হৃদযন্ত্রে কোষের স্তর গ্রাফটিং করে দেন।

আইপিএস কোষ যেভাবে কাজ করে

বেশ কয়েক দশক ধরেই বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হৃদরোগের চিকিৎসায় গবেষকেরা প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম সেল ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। তাঁরা আশা করেন, হৃদপেশিতে এ কোষ দেওয়া হলে তা রূপান্তরিত হয়ে কাজ করবে। কিন্তু মানুষের ওপর পরীক্ষা করে এর কার্যকারিতা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি গবেষকেরা। তাই তাঁরা আইপিএস কোষ নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক কোষকে ভ্রূণ দশায় নিয়ে যান, যা দিয়ে কার্ডিওমায়োসাইটসের মতো অন্য কোষ তৈরি করা সম্ভব। এ ছাড়া সরাসরি ভ্রূণ থেকে সংগ্রহ করা স্টেম সেলের মতো আইপিএস কোষের ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্ন নেই।

গবেষকেরা ইঁদুর ও বানরের ওপর আইপিএস কোষ নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন। আইপিএস থেকে উদ্ভূত কার্ডিওমায়োসাইটস সরাসরি হৃদযন্ত্রে দেওয়া হলে তা পেশিকোষ পুনরুৎপাদন করতে পারে ও হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম উন্নত করে। গবেষকেরা আশা করেন, মানুষের ক্ষেত্রে পরীক্ষায় একই ফল পাওয়া যাবে।

জার্মানির ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার গ্যাটিনজেনের ফার্মাকোলজিস্ট ওল্ফ্রাম-হুবার্টস জিম্মারম্যান বলেছেন, ‘এটি সত্যিই উত্তেজনাপূর্ণ সময়। মানুষের ক্ষেত্রে প্রথম পরীক্ষার ফল সম্ভাবনাময় বলে মনে হচ্ছে। তবে ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি বলে এ চিকিৎসা কার্যকর কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’

স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা করে কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবন করছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স
স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা করে কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবন করছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স

শুরু হচ্ছে আরও পরীক্ষা

চীন ও জাপানের পাশাপাশি আইপিএস কোষ নিয়ে পরীক্ষা শুরু করতে যাচ্ছে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। তবে কার্ডিওমায়োসাইটস কীভাবে হৃদযন্ত্রের মেরামত করে ও কীভাবে হৃদযন্ত্রে দিলে ভালো হবে, তা নিয়ে গবেষকেদের মতপার্থক্য রয়েছে।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক চার্লস মারি বলছেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে অনেক বিস্ময়কর অগ্রগতি আমরা দেখতে পাব।’

তবে এ ধরনের চিকৎসাপদ্ধতির নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আইপিএস কোষ থেকে নিখুঁত ও বিশাল পরিমাণে কার্ডিওমায়োসাইটস আহরণ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এতে প্রচুর সময় ও শ্রম যায় বলে অল্পসংখ্যক কোম্পানি এ কাজ করছে। ওয়াং জিয়াশিয়ান বলেন, চার বছর ধরে তাঁর কোম্পানি কাজ করছে।

সার্জন ওয়াং বলেন, 'একজন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির কাছ থেকে সংগৃহীত কোষ থেকে ১০ কোটি কার্ডিওমায়োসাইটস তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হৃদপেশিতে ইনজেকশন দেন। একই সময় তাদের বাইপাস সার্জারি করা হয়। রোগীর নিরাপত্তা তাঁদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। অপারেশনের পর হৃদযন্ত্রের উন্নতি তাঁদের আশা দেখিয়েছে। কোনো রোগীর টিউমার হয়নি, যা প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল ব্যবহারের একটি ঝুঁকি বলে ধরা হয়।’

শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা যাতে কার্ডিওমায়োসাইটসের ওপর আক্রমণ না করে সে জন্য রোগীদের ইমিউন সিস্টেমকে ভালো রাখার ওষুধ দেওয়া হয়। সার্জারির এক মাস পরেই রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পান।