করোনার সময় কেন উপুড় হয়ে ঘুমানো ভালো?

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনা আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। ওই সময় তাদের উপুড় হয়ে শোওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। এটা আজ নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়ার রোগীদের একই পরামর্শ দেওয়া হতো। পেটের নিচে বালিশ রেখে ঘুমানো কষ্টকর। সে ক্ষেত্রে অল্প সময়ের জন্য হলেও উপুড় হয়ে শুয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলে উপকার পাওয়া যায়। গত মাসে (১৪ এপ্রিল, ২০২০) সিএনএনে স্বাস্থ্যবিষয়ক এক আলোচনায় সিনিয়র মেডিকেল করেসপনডেন্ট এলিজাবেথ কোহেন বলেন, একজন গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীর জন্য এই পরামর্শে সুফল পাওয়া গেছে।

সাত বছর আগে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে ফরাসি চিকিৎসকদের একটি লেখা ছাপা হয়। সেখানে বলা হয় এআরডিএস (অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রম) বা শ্বাসতন্ত্রের চরম জটিলতায় আক্রান্ত যে রোগীদের ভেন্টিলেশনে রাখা হয়, তাদের উপুড় হয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করলে মৃত্যুর আশঙ্কা কমে।

পেটের ওপর ভর দিয়ে শুয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে কী লাভ হয়, সেটাই প্রশ্ন। এ বিষয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেন, ফুসফুসের একটি বড় অংশই রয়েছে পিঠের দিকে, বুকের দিকে নয়। উপুড় হয়ে শোওয়ার সুবিধা হলো ফুসফুসের বেশির ভাগ অংশ সহজে প্রচুর অক্সিজেন পায়। এবং সেটাই তাদের সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করে। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে শোওয়ার ভঙ্গি পরিবর্তনের ফলে তাদের রক্তে অক্সিজেনের অংশ ৮৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এই দুঃসময় অনেক চিকিৎসক রোগীদের বলেন, প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য হলেও উপুড় হয়ে শোওয়া ভালো। অস্বস্তি লাগলে অন্তত পাশ ফিরে শোওয়া উচিত।

লকডাউন শিথিলের পর

এ মাসের শেষ দিকে সরকারের সাধারণ ছুটির মেয়াদ শেষ বলে জানানো হয়েছে। কিছু বিধিনিষেধ সাপেক্ষে বেশির ভাগ কলকারখানা, অফিস, ব্যাংক প্রভৃতি পুরোদমে কাজ শুরু করবে। অবশ্য সামাজিক বা ব্যক্তির শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মুখে সব সময় মাস্ক পরা, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া প্রভৃতি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এখন প্রশ্ন এর ফলে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাবে কি না। এখানে আশঙ্কাই বেশি। কারণ আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস প্রায় নেই। সে ক্ষেত্রে করোনা রোগের বিস্তার বাড়তে পারে। নির্ভর করে আমরা নিজেরা কতটা সতর্কতা মেনে চলতে পারি তার ওপর।

করোনা সংক্রমণের জন্য অন্তত ১ হাজার ভাইরাস কণা আমাদের নাক-মুখ দিয়ে ঢুকতে হবে। করোনা সংক্রমিত কোনো ব্যক্তি একবার কাশি দিলে ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগে প্রায় ৩ হাজার ড্রপলেট বের হয়। এর বেশির ভাগই ভারী বলে একটু দূরে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়, কিন্তু কিছু ড্রপলেট বাতাসে বেশ কিছুক্ষণ ভেসে বেড়ায়। এক হাঁচিতে ঘণ্টায় ২০০ মাইল বেগে ৩০ হাজার ড্রপলেট ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসে অল্প বেগে ৫০ থেকে ৫ হাজার ড্রপলেট ছড়ায়। এই হিসাবগুলো পাওয়া যাবে ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস ডার্টমাউথের জীববিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এরিন এস ব্রোমেজের ব্লগে লেখা থেকে। তিনি বলেছেন, জনবহুল এলাকায় বেশিক্ষণ থাকলে করোনায় কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত হতে পারেন। কারণ তিন বা ছয় ফুট দূরে থাকলেও, সরাসরি হয়তো ড্রপলেট কাউকে সংক্রমিত করতে পারবে না। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে হয়তো কোনো ব্যক্তি হাঁচি-কাশি দিয়ে গেছেন। তাঁর ছড়িয়ে যাওয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

সুতরাং লকডাউন শিথিল হওয়ার পর মুখে মাস্ক ও শারীরিক দূরত্ব মেনে চললেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকবে, যদি জনবহুল এলাকায় বেশিক্ষণ কেউ থাকেন। তাই এ সময় এসব বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। যত বেশি ঘরে থাকা যায়, ততই ভালো।

তিন ফুট না ছয় ফুট
আমরা সাধারণত বলি ব্যক্তি-ব্যক্তিতে অন্তত তিন ফুট দূরত্ব থাকতে হবে। কারণ করোনাভাইরাস তুলনামূলক একটু ভারী বলে এর বাহক ড্রপলেটগুলো তিন ফুটের বেশি দূর যেতে পারে না, এর আগেই মাটিতে পড়ে যায়। সুতরাং তখন তিন ফুটের বেশি দূরে থেকে কোনো ব্যক্তির শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার ভয় থাকে না। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, তিন ফুটের চেয়ে বরং ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখা ভালো। এই তিন-ছয়ের গন্ডগোল কেন? প্রথমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলেছিল। সেটা ছিল সেই ১৯৩০ সালে একজন হার্ভার্ড রিসার্চারের হিসাব অনুযায়ী। কিন্তু পরে দেখা গেল, তিন ফুট নয়, ছয় ফুট দূরত্বই নিরাপদ। বাইরে খোলামেলা স্থানে কম লোকজন থাকলে এই দূরত্ব নিশ্চিত হওয়া যায়। এর ওপর আছে সূর্যরশ্মি, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার প্রভাব, যা ভাইরাসকে দুর্বল করে। এই পরিস্থিতিতে এখন আমরা বলি, শারীরিক দূরত্ব ছয় ফুট রাখাই বাঞ্ছনীয়।

আব্দুল কাইয়ুম, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
[email protected]