ইন্টেলের সঙ্গে দোস্তি ভেঙে নতুন মিশনে অ্যাপল

ইন্টেলের তৈরি চিপ ব্যবহার না করার ঘোষণা দিয়েছে অ্যাপল। ছবি: এএফপি ও রয়টার্স
ইন্টেলের তৈরি চিপ ব্যবহার না করার ঘোষণা দিয়েছে অ্যাপল। ছবি: এএফপি ও রয়টার্স

প্রায় ১৫ বছরের দোস্তি। ভেঙে গেল এক ঘোষণাতেই। এত দিন অ্যাপলের ম্যাক পিসির জন্য চিপ তৈরি করত ইন্টেল। কিন্তু সম্প্রতি অ্যাপল জানিয়েছে, আর ইন্টেল নয়; এবার চিপ নিজেরাই তৈরি করবে। আর এতেই বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি ব্যবসার অনেক হিসাব-নিকাশ বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি অ্যাপ ডেভেলপারদের নিয়ে আয়োজন করা এক বার্ষিক সম্মেলনে ম্যাক পিসির জন্য নিজস্ব চিপ তৈরির ঘোষণা দিয়েছে অ্যাপল। বলা হয়েছে, এ বছরের শেষেই চলে আসবে নতুন চিপের ম্যাক পিসি। আর নতুন চিপের ব্যবহার সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজন হবে দুই বছর। এর মধ্যে বাজারে আসা সব ম্যাক পিসিতেই দেওয়া হবে নতুন চিপ।

এই নতুন চিপকে আপাতত 'অ্যাপল সিলিকন' বলে ডাকা হচ্ছে। এর নকশা করেছে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান এআরএম। অ্যাপলের দাবি, নতুন এই চিপ ইন্টেলের তৈরি চিপের তুলনায় অনেক বেশি গতিশীল হবে। এ ছাড়া নতুন চিপ হবে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী। ফলে ম্যাক পিসির ব্যাটারির সেবা দেওয়ার ক্ষমতা বেড়ে যাবে।

অ্যাপল যে এই প্রথম নিজেদের তৈরি চিপ ব্যবহার করছে - ব্যাপারটি কিন্তু তেমন নয়। অনেক আগে থেকেই আইফোন ও আইপ্যাডে এআরএমের নকশায় তৈরি নিজস্ব চিপ ব্যবহার করে আসছে অ্যাপল। তবে ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে নতুন চিপের ব্যবহার এবারই প্রথম। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে চিপের জন্য আর কারও ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না অ্যাপল। বরং নিজেদের পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে চাইছে।

ম্যাক পিসির জন্য নিজস্ব চিপ তৈরির ঘোষণা দিয়েছে অ্যাপল। ছবিটি প্রতীকী। ছবি: এএফপি
ম্যাক পিসির জন্য নিজস্ব চিপ তৈরির ঘোষণা দিয়েছে অ্যাপল। ছবিটি প্রতীকী। ছবি: এএফপি

নিয়ন্ত্রণ শব্দটি যখন সামনে এল, তখন এর আরেকটু বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেওয়া যাক। নিন্দুকেরা বলে থাকেন, অ্যাপলের ব্যবসা-কাঠামোতে নিয়ন্ত্রণই মূল মন্ত্র। গত কিছুদিন ধরেই অ্যাপলের আইফোন, আইপ্যাড ও ম্যাক পিসির বিক্রিতে ভাটার টান দেখা দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতি তাতে ধস নামিয়েছে। অ্যাবাভ অ্যাভালন নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একজন ব্যবহারকারীর প্রথম আইফোন কেনার হিসাবে ২০১৬ সালে শীর্ষে ছিল অ্যাপল। এখন তা ৬৩ শতাংশ কমে গেছে। তাই শুধু ডিভাইস বিক্রির ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না অ্যাপল। আর কয়েক বছর ধরেই সার্ভিস বিক্রিতে মনোযোগী হয়েছে অ্যাপল। অনলাইন ভিডিওস্ট্রিমিং ব্যবসাতেও এই কারণেই নেমেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন টিম কুকের প্রতিষ্ঠান চাইছে সার্ভিস বিক্রির ব্যবসায় পুরো নিয়ন্ত্রণ। বিশেষ করে অ্যাপ্লিকেশনসের বাজার হাতের মুঠোয় নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু অ্যাপ স্টোরে থাকা অ্যাপসগুলোর মাধ্যমেই বছরে প্রায় ৫১৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। এবার এতে ভাগ বসাতে চাইছে অ্যাপল।

নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, কীভাবে? আসুন, উত্তর খোঁজা যাক। আইফোন ও আইপ্যাডের জন্য বিশেষায়িত অ্যাপস ব্যবহার করতে হয়। ম্যাক পিসির ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু আইফোন ও আইপ্যাডের অ্যাপস শুধু অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর থেকেই কিনতে হয়। এর বাইরে ডেভেলপারদের সাইট থেকে সরাসরি ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যায় না। আইফোন ও আইপ্যাড - এই দুটোতেই নিজস্ব চিপ ব্যবহার করে থাকে অ্যাপল। কিন্তু ম্যাক পিসির ক্ষেত্রে ডেভেলপারদের কাছ থেকেও সরাসরি অ্যাপস কেনা যেত। অ্যাপলের নিজস্ব পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার না করলেও চলত। এখন ইন্টেলের চিপ বাদ দিয়ে নতুন চিপ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় চাইলে ম্যাক পিসির ক্ষেত্রে বাইরের উৎস থেকে অ্যাপস ডাউনলোড করার বিকল্প উপায় বন্ধ করে দিতে পারবে অ্যাপল।

অ্যাপলের সিইও টিম কুক। ছবি: এএফপি
অ্যাপলের সিইও টিম কুক। ছবি: এএফপি

বিশ্লেষকেরা বলছেন, অ্যাপল মূলত চাইছে তার সব ডিভাইসে নিজেদের তৈরি বিশেষায়িত চিপ করতে। এর মধ্য দিয়ে অ্যাপস কেনাকাটার বিষয়টি পুরোপুরি নিজেদের হাতে নিয়ে নিতে চায় অ্যাপল। কারণ অ্যাপ স্টোরে অ্যাপ কেনার ক্ষেত্রে এবং সার্ভিস বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতি লেনদেনে ৩০ শতাংশ অর্থ অ্যাপল কেটে রাখে। এ থেকে বিপুল অঙ্কের আয় হয় প্রতিষ্ঠানটির। অ্যাপলের নিজস্ব পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার না করলে অ্যাপ স্টোর থেকে অ্যাপ কেনা যায় না। ফলে ডেভেলপারদের সঙ্গে ক্রেতাদের সরাসরি লেনদেনের মাঝে থাকে অ্যাপল। আর এই বিষয়টিই নতুন চিপের মাধ্যমে আরও কঠোর করতে চাইছে অ্যাপল, যাতে আইফোন ও আইপ্যাডের মতো একই শর্তের অধীনে চলে আসে ম্যাক পিসি।

অ্যাপল বলছে, আইপ্যাড, আইফোন ও ম্যাক পিসি - তিন ক্ষেত্রেই এখন এআরএমের নকশায় তৈরি নিজস্ব চিপ ব্যবহৃত হবে। ফলে তিন প্ল্যাটফর্মের জন্য আর আলাদা আলাদাভাবে অ্যাপস বানাতে হবে না। এক অ্যাপস চালানো যাবে তিন প্ল্যাটফর্মেই। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে ম্যাক পিসির ইন্টেল চিপের ওপর ভিত্তি করে তৈরি এত দিনকার অ্যাপসগুলো আর চলবে না। সেগুলো নতুন করে কোডিং করতে হবে। আর এখানেই মোক্ষম চাল চেলেছে অ্যাপল। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ম্যাক পিসির জন্য নতুন করে কোডিং করা অ্যাপসগুলো অ্যাপ স্টোরে দিতে বাধ্য করতে পারে অ্যাপল। আর তখনই প্রতি লেনদেনে ৩০ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়ার শর্তে রাজি হতে হবে ডেভেলপার কোম্পানিগুলোকে। এতে একদিকে অ্যাপলের আয় অনেক বেড়ে যাবে, অন্যদিকে অ্যাপস নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমে যাবে।

অবশ্য এরই মধ্যে অযাচিত নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ডিজিটাল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে অ্যাপল। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কাছে অভিযোগ দিয়েছে স্পটিফাই, কোবো, হেই - এর মতো অ্যাপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা বলছে, অ্যাপল তার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অ্যাপ নির্মাতা ও ডিজিটাল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি নিপীড়ন চালাচ্ছে। ব্যবহারকারী ও সেবাদাতা - উভয় পক্ষের ওপরই বিভিন্ন শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে এবং মানতে বাধ্য করছে। এখন এই অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

অ্যাপল পাশ থেকে সরে যাওয়ায় বাজারে ইন্টেলের ক্রেতাদের আস্থায় ফাটল দেখা দিতে পারে। ছবি: এএফপি
অ্যাপল পাশ থেকে সরে যাওয়ায় বাজারে ইন্টেলের ক্রেতাদের আস্থায় ফাটল দেখা দিতে পারে। ছবি: এএফপি

লাভ-ক্ষতির বয়ান

ওপরের আলোচনায় নিজস্ব চিপ চালু করায় অ্যাপলের লাভ কতটুকু, তার আন্দাজ নিশ্চয়ই পাওয়া গেছে। এবার আসা যাক অঙ্কের হিসাবে। অ্যাপলের দাবি, তাদের নতুন চিপ আরও উন্নত, গতিশীল ও বিদ্যুৎসাশ্রয়ী হবে। ফলে ম্যাক পিসির ব্যাটারি ও কুলিং ফ্যানের সক্ষমতায় কিছুটা হেরফের করতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি। এক হিসাবে দেখা গেছে, যদি নতুন চিপ ব্যবহার করে ২০২২ সাল নাগাদ ২ কোটি ম্যাক বিক্রি করতে পারে অ্যাপল, তবে প্রতিষ্ঠানটির সাশ্রয় হবে ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ।

এর বাইরে আছে কম্পিউটারের চিপ নির্মাতা হিসেবে স্বীকৃতি। এইচপি, ডেলসহ সব কম্পিউটার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান চিপের জন্য ইন্টেল বা এএমডির ওপরই নির্ভরশীল। এর মধ্যে অ্যাপল নিজস্ব চিপ ব্যবহার শুরু করলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি বাজারমূল্যও বাড়বে প্রতিষ্ঠানটির। অন্যান্য কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বাজার প্রতিযোগিতায় বেশ খানিকটা এগিয়ে যাবে অ্যাপল।

অ্যাপলের লাভের উল্টো পিঠেই আছে ইন্টেলের ক্ষতি। আর্থিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এভারকোর বলছে, অ্যাপলের ম্যাক পিসির জন্য চিপ বানিয়ে বছরে ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে থাকে ইন্টেল। ইন্টেলের মোট আয়ের ৫ শতাংশ এটি। তবে অর্থনৈতিক ধাক্কার চেয়েও বড় ধাক্কা লেগেছে ইন্টেলের সুনামে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যাপল পাশ থেকে সরে যাওয়ায় বাজারে ইন্টেলের ক্রেতাদের আস্থায় ফাটল দেখা দিতে পারে। যদিও ইন্টেলের চিপ আরও কিছুদিন ব্যবহার করবে অ্যাপল, তবে তা ক্ষতে প্রলেপ হবে না।

লাভের খাতায় আরেক পক্ষ আছে। সেটি হলো তাইওয়ানের চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টিএসএমসি। ইন্টেল যেমন চিপ উৎপাদনের পাশাপাশি নকশাও করে থাকে, টিএসএমসি তেমন নয়। এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু চিপ উৎপাদন করে। ধারণা করা হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমেই নতুন চিপসেট উৎপাদন করবে অ্যাপল। কারণ টিএসএমসি অনেক আগে থেকেই আইফোন ও আইপ্যাডের জন্য চিপসেট বানিয়ে আসছে। তাই অ্যাপল স্বাভাবিকভাবেই পুরোনো বন্ধুর ঘাড়ে ভর করতেই পারে।

এ ক্ষেত্রে টিএসএমসি উপকৃতও হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বিধি নিষেদের কারণে গত মে মাস থেকে আর হুয়াওয়ের জন্য চিপ বানাতে পারছে না টিএসএমসি। অথচ প্রতিষ্ঠানটির আয়ের ১৫ শতাংশ আসত হুয়াওয়ে থেকে। এখন অ্যাপলের নতুন চিপসেট বানানোর কাজ পেলে বর্তে যাবে টিএসএমসি।

চীনে অ্যাপলের একটি কারখানার দৃশ্য। ছবি: এএফপি
চীনে অ্যাপলের একটি কারখানার দৃশ্য। ছবি: এএফপি

অ্যাপল পারবে?

টেক জায়ান্ট অ্যাপল প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছে মূলত নিজেদের অনন্য উদ্ভাবনী ভাবনার মাধ্যমে। এখন প্রতিষ্ঠানটি প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। অ্যাপলের সাফল্যের পেছনে চীনের সস্তা শ্রমের অবদানও অনেক। করোনাভাইরাসের কারণে এরই মধ্যে বেশ চাপে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন চিপ তৈরির ঘোষণা দেওয়ার মধ্য দিয়ে একটি চমক আনতে চাইছেন টিম কুক। সেই সঙ্গে সার্ভিস ব্যবসায় আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে অ্যাপল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ নিয়ে এরই মধ্যে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে এবং আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। সব মিলিয়ে চমক দেখানোর পাশাপাশি চাপেও আছে অ্যাপল। সামনের পথ তাই মসৃণ হবে না, হবে বন্ধুর।

তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য ইকোনমিস্ট, ফরচুন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, সিএনবিসি ও ফোর্বস