ডিজিটাল সেবায় ইলেকট্রনিক সিগনেচার

ডিজিটাল সেবায় ইলেকট্রনিক সিগনেচার থাকা জরুরি।
ডিজিটাল সেবায় ইলেকট্রনিক সিগনেচার থাকা জরুরি।

বিশ্বায়নের নানা কর্মযজ্ঞ আর ডামাডোলে প্রস্তুতি চলছিল চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের। এর মধ্যেই করোনার আঘাতে ব্যবসার নানা কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তি আরও বেশি আপন হয়ে উঠছে। তথ্যপ্রযুক্তির নানা ধরনের পরিষেবা বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও দ্রুতগতিতে বাড়ছে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য। নতুন ধারণা নিয়ে দেশে নিয়মিত উঠে আসছে স্টার্টআপগুলো। সামাজিক নিরাপত্তা মেনে চলার প্রবণতার কারণে ই-কমার্সের মতো পরিষেবার ব্যবহার ও ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু ডিজিটাল কর্মকাণ্ডে পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা নিয়ন্ত্রকেরা কতটা তৎপর? ব্যবহারকারীর তথ্যের নিরাপত্তা বা আর্থিক নিরাপত্তাব্যবস্থাকে সুরক্ষিত, আধুনিকায়ন করা হলে বিশ্বমানের ডিজিটালাইজেশনের পথে থাকার গতি পাবে বলা যায়। তথ্যের নিরাপত্তাসহ আইনি ব্যাপারগুলোয় পরিষেবা প্রতিষ্ঠান বা সার্ভিস প্রোভাইডারের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রকদেরও ভূমিকা রয়েছে। আধুনিকায়ন বা পর্যাপ্ত ইকোসিস্টেম তৈরির জন্য এগিয়ে আসতে হবে নিয়ন্ত্রণকারীদের। প্রতিটি লেনদেন নিরাপদ বা প্রক্সিমিটি নিশ্চিত রাখার জন্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সিগনেচার বা ডিজিটাল সার্টিফিকেট অপরিহার্য।

ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সিগনেচার আসলে কী? মোটাদাগে বা সহজ কথায় বলা যায়, ইলেকট্রনিক সিগনেচারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করে ইউনিক এনক্রিপশন যুক্ত করে পাঠানো হয়, যাতে প্রেরকের তথ্য সঠিক বলে নিশ্চিত ধরা হয়।

পৃথিবীর অনেক দেশেই ইলেকট্রনিক লেনদেন বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ই-গভর্নমেন্টের নানা পরিষেবা নিরাপদ, সুরক্ষিত রাখতে ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে ওই সমস্ত দেশের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। ই-গভর্নমেন্ট, ই-কমার্স, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোয় ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবহার না করলে সেবাদানকারী, ব্যবহারকারীসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা বেশ কঠিন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে নানা ধরনের নথিপত্রের বিনিময়েও ডিজিটাল সিগনেচার খুবই দরকারি উপাদান হিসেবে উন্নত অনেক দেশেই ব্যবহার হচ্ছে।

ইলেকট্রনিক সিগনেচারকে ডিজিটালাইজেশন ইকোসিস্টেমের একটি বড় উপাদান বলা যেতে পারে। তাই ডিজিটাল পরিষেবার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে এটা নিয়ে কাজ করা উচিত। দেশে অবশ্য ইতিমধ্যে ইলেকট্রনিক সিগনেচার ব্যবহারের আইন ও অবকাঠামো তৈরি হয়েছে।

অপ্রতিসম (Asymmetrie) ক্রিপ্টোগ্রাফি (Cryptography) বা ক্রিপ্টোগ্রাফিক (cryptographic) প্রটোকলই আসলে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সিগনেচারের প্রতিরূপ। যেমন ধরা যাক, ক নামের ইন্টার ব্যাংকিং ব্যবহারকারী খ–কে ৫০ হাজার টাকা পাঠাবে। ক ব্যাংকিং সিস্টেমে লগইন করে, ডিজিটাল সিগনেচার যুক্ত করে লেনদেন সম্পন্ন করবে, যাতে নিশ্চিত হয় ক–ই ওই লেনদেন করেছে। কিংবা ব্যবহারকারী কোনো ই-কমার্স সাইটে লগইন হয়ে কোনো পণ্য কিনতে চাইছে আর পণ্যের দাম পরিশোধের জন্য তার ভার্চ্যুয়াল ওয়ালেট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করার জন্য তাকে ডিজিটাল সিগনেচার যুক্ত করে লেনদেন সম্পন্ন করতে হবে। ট্যাক্সে সার্ভিসের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবহারের জন্য পাবলিক কি (Key) আর প্রাইভেট কি (Key) থাকতে হয়। ইলেকট্রনিক সিগনেচারের মেরুদণ্ড হচ্ছে পাবলিক কির (public key) অবকাঠামো। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে বিশ্বস্ত সার্টিফিকেট কর্তৃপক্ষ (Certificate Authority)। সহজ কথায় বলতে গেলে সার্টিফিকেট কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় আইন, বিশ্বমানের সঙ্গে নিয়মনীতি মেনে তার সিস্টেম প্রস্তুত করে।

ব্যবহারকারী সাধারণত তার কম্পিউটার, এক্সটারনাল ড্রাইভ, ক্লাউড ড্রাইভ বা মোবাইলে ডিজিটাল সিগনেচার সংরক্ষিত রাখে। যখন ব্যবহার করার দরকার পড়ে, তখন সংরক্ষিত ড্রাইভ থেকে এনে ব্যবহার করতে পারে। অনেক দেশেই সার্টিফিকেট বা সিগনেচার রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষ ব্যাংক বা আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে। তবে সার্টিফিকেট অথোরিটি সরকারি নিয়ম মেনে কিছু কোম্পানি, যাদের বিশ্বমানের পাবলিক কি অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আছে, তারা পরিচালনা করে থাকে। এ ধরনের সিগনেচার ব্যবহার করার জন্য ব্যবহারকারী, পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের সচেতনতাও জরুরি। প্রযুক্তি নিয়ে নানা সেবা বা পরিষেবা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের তাদের ব্যবসার তথ্য বা ব্যবহারকারীর তথ্যের সুরক্ষার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে ইলেকট্রনিক সিগনেচার প্রচলনে এগিয়ে আসতে হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, বিগ ডেটা আর ডেটার ভার্চ্যুয়ালাইজেশনের ব্যাপকতায় নানা ধরনের বাণিজ্যিক পদ্ধতি অচিরেই বহুগুণ বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা হবে নিরাপদ ব্যবসা ব্যবস্থাপনার। কোভিড-১৯–এর ধাক্কা সামলিয়ে প্রযুক্তি ব্যবসার ব্যবস্থাকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ইলেকট্রনিক সিগনেচার কাজে লাগবে।

লেখক: এম এন ইসলাম
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টিকন সিস্টেম লিমিটেড