চার রোবটের কথা

ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষের অবস্থান জানানোর রোবট তৈরি করেছেন এই ছাত্ররা
ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষের অবস্থান জানানোর রোবট তৈরি করেছেন এই ছাত্ররা

চারটা রোবট। নানা কাজের। রোবটগুলো বানিয়েছেন যাঁরা তাঁরা সবাই শিক্ষার্থী। তাঁরা পড়ছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েটে)। আজ থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির মেলা ‘বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপো ২০১৫’। এ মেলায় তরুণদের উদ্ভাবন নিয়ে থাকছে ‘ইনোভেশন জোন’। সেখানে আরও উদ্ভাবনের সঙ্গে দেখা যাবে এই চার রোবটও।

রোবোকার
রোবোকার

শুধু কথাতেই চলবে রোবোকার
গাড়ির চালকের আসনে বসে স্টিয়ারিং হাতে নেওয়ার বদলে মুখ দিয়ে বললেন ডানে চলো, গাড়িটি ডানে চলা শুরু করল। তাড়া থাকায় গতিবেগ কিছুটা বাড়াতে বলতেই চলার গতি বাড়িয়ে দিল। কেমন হয় ব্যাপারটা? এমন কিছুই তৈরি করতে চলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের চার শিক্ষার্থী আসির ইনতিসার খান, অর্ণব ভট্টাচার্য, ইশতিয়াক আহমেদ ও আকীব ইকবাল। একই বিভাগের অধ্যাপক শেখ আনোয়ারুল ফাত্তাহর তত্ত্বাবধানে তাঁরা তৈরি করেছেন ‘মাল্টিপারপাজ ভয়েজ কনট্রোলড রোবোকার’।
কথা হয় আসির ইনতিসার খানের সঙ্গে। নামের মতোই রোবটটির ব্যবহার এবং সম্ভাবনা অসীম—জানান তিনি। রোবটের মূল বৈশিষ্ট্য এটি বাংলা কথা শনাক্ত করে সে অনুযায়ী নির্দেশ পালন করতে পারে। আপাতত আগে থেকে নির্ধারিত পাঁচটি নির্দেশ পালন করলেও রোবট উন্নয়নের কাজ চলছে। আসির বললেন, ‘এখানে সফটওয়্যার অংশটি মূল। আমরা দেড় বছর ধরে কাজ করেছি এটা নিয়ে। রোবোকার তৈরি মূলত সফটওয়্যারটির বাহ্যিক ব্যবহার দেখানোর জন্য।’

কথার নির্দেশনার পাশাপাশি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ এবং কিবোর্ড দিয়েও রোবোকারটি চালানো যাবে। সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে স্মার্টহুইল চেয়ার তৈরি করা যেতে পারে। নিজে যেমন চালানো যাবে, চাইলে অন্য কেউ দূর থেকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এ ছাড়া বড় শিল্পে নানা কাজ করতে পারবে বলেও জানালেন আসির।

রোবোকারের নির্মাতারা
রোবোকারের নির্মাতারা

উদ্ধারকাজের জন্য
সাভারের রানা প্লাজা ধসের দুই বছরের বেশি পার হলেও এখনো খোঁজ মেলেনি সব নিখোঁজ মানুষের। কিংবা সাম্প্রতিক নেপালে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথাই ভাবুন। ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে থাকা মানুষদের উদ্ধার করাটা সময়সাপেক্ষ। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জীবিত মানুষের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া। কারণ মানুষের পক্ষে ধ্বংসস্তূপের নিচে সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। আর এটা ভেবেই শোয়াইব বিন মাসুদ, মুস্তাকিম রিফাত, জাকারিয়া হায়দার, মৃণ্ময় সরকার, ধীমান চৌধুরী এবং গোলাম রাব্বি তৈরি করেছেন ম্যাপ এক্সপ্লোরার রোবট। এঁরাও সবাই পড়েন বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগে। তাঁদের তৈরি রোবট ধ্বংসস্তূপের নিচে গিয়ে মানুষের অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করবে। দূর থেকে রোবটটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে আর রোবটের সঙ্গে থাকা ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি সরাসরি ভেসে উঠবে পর্দায়। প্রাথমিকভাবে নকশা করা রোবটটির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তারহীন ব্লুটুথ সংযোগ ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ৩০ ফুটের বেশি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে ওয়াই-ফাই ব্যবহারের ইচ্ছা আছে নির্মাতাদের। জাকারিয়া হায়দার বলেন, ‘কোথাও যদি রোবটটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তো রোবটটি নিজে থেকেই আগের জায়গায় ফিরে আসবে।’
ব্রেইল আর ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিংয়ে আর্মবট
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পড়ার উপযোগী মুদ্রণ ব্যবস্থার নাম ব্রেইল। বুয়েটের ছাত্র অনিক চৌধুরী, শেখ তানভীর আহমেদ, সৈয়দ ইমাম হাসান, জাহিন মুস্তাকিম, মুনিফ ইশাদ মুজিব এবং রাতুল খানের তৈরি রোবট ‘স্কারা আর্মবট’ সহজে এবং সুলভে এই ব্রেইল ছাপার কাজ করতে পারে। তবে রোবটটির আরও ব্যবহার আছে। বিশেষ করে শিল্পক্ষেত্রে যন্ত্রাংশ সংযোজন এবং প্লটার ও থ্রিডি প্রিন্টিংয়ে এই রোবট কাজে লাগানো যাবে। রোবটটি কীভাবে কাজ করে তা জানালেন অনিক চৌধুরী। অনেকটা কম্পিউটারের মাউসের মতো। মাউসের নিচের সমতল ভূমিকে এক্স এবং ওয়াই অক্ষে নির্ধারণ করে মাউসের অবস্থানের স্থানাঙ্ক পাঠায় কম্পিউটারে। পর্দায় সে অনুযায়ী কার্সরের অবস্থান দেখি আমরা। স্কারা আর্মবট এভাবেই স্থানাঙ্ক নির্ধারণের কাজ করে প্রিন্ট করে। তবে স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের জন্য কার্তেসীয়র বদলে বৃত্তীয় স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়েছে বলে জানান অনিক চৌধুরী।

ব্রেইল ও থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের জন্য রোবট বানিয়েছেন এঁরা
ব্রেইল ও থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের জন্য রোবট বানিয়েছেন এঁরা

স্মার্ট রোবট
আলআরাবি এবং খালেদ বিন মইনুদ্দিনের তৈরি স্মার্ট রোবটটির ব্যবহার মূলত বাণিজ্যিক কাজে। এ দুজন পড়ছেন বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগে। ভারী শিল্পে বিভিন্ন কাজে স্বয়ংক্রিয়তা আনতে ব্যবহার করা যাবে তাঁদের রোবটটি। তবে তার আগে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হবে। আলআরাবির ভাষায় ব্যাপারটা এমন, ধরুন রোবটটিকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হলো যে আগামী এক সপ্তাহ যত লাল রঙের পণ্য তৈরি হবে তা এক বাক্সে, সবুজ রঙের পণ্য আরেক বাক্সে সাজিয়ে রাখতে হবে। রোবট প্রথমে পুরো ঘরটি স্ক্যান করে নিয়ে চলার সম্ভাব্য সব পথ তৈরি করে নেবে। অ্যালগারিদমে নির্ধারণ করে দিতে হবে এটা কীভাবে কাজ করবে। এরপর নতুন কোনো নির্দেশ দেওয়ার আগ পর্যন্ত রোবটটি একই কাজ করতে থাকবে। চলার পথে সামনে কোনো বাধা এলে তা এড়িয়ে যাওয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে রোবটটিতে।