হৃৎপিণ্ড নাকি বোমা?

হৃৎপিণ্ড
হৃৎপিণ্ড

হৃদ্‌রোগে রোজই মানুষ মরছে। বাঁচিয়ে রাখার কি কোনো উপায় নেই? এ প্রশ্ন হরদম বিশেষজ্ঞদের মাথায় ঘুরছে। কৃত্রিম হৃদয় লাগানোর কথা বলেন অনেকে। এতেও বিপত্তি কম নয়। গবেষকেরা বলেন, সে যন্ত্রটি চালাতে তো শক্তি লাগবে! সে শক্তি যদি পরমাণু থেকে আসে? তবে মানুষ কি আর মানুষ থাকবে? মানুষের হৃৎপিণ্ড হয়ে যাবে একটি আস্ত পারমাণবিক বোমা! সত্যি সত্যিই পারমাণবিক শক্তিচালিত হৃদ্‌যন্ত্র তৈরির চেষ্টা করেছিলেন গবেষকেরা। তাতে বিনিয়োগ করেছিল মার্কিন সরকার। ঘটনাটি ষাটের দশকের। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ওই গবেষণা চলেছে, কিছুটা প্রকাশ্যে, কিছুটা গোপনে।

যুক্তরাষ্ট্রে হৃদ্‌রোগই সবচেয়ে বড় ঘাতক। সেখানে প্রতিবছর ছয় লাখ মানুষ হৃদ্‌রোগে মারা যায়। হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যায় আক্রান্ত এই সমাজে হৃদ্‌যন্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ এই প্রত্যক্ষ দীর্ঘ মেয়াদে বদলে ফেলা অনেক জটিল একটি বিষয়। ১৯৬৭ সালে গবেষকেরা হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা সমাধানে একটি কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডের কথা ভেবেছিলেন, যা তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের শক্তিতে চলবে। অর্থাৎ, গবেষকেরা অ্যাটোমিক বা পারমাণবিক শক্তিতে চলা হৃৎপিণ্ডের কথা চিন্তা করেছিলেন। মার্কিন সরকারের অর্থায়নে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ন্যাশনাল হার্ট ইনস্টিটিউট (এনএইচআই) ও অ্যাটোমিক এনার্জি এজেন্সির (এইসি) গবেষকেরা পারমাণবিক হৃদ্‌যন্ত্র তৈরির স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। তাঁরা দাবি করেন, অসুস্থ হৃদ্‌যন্ত্রকে পরিবর্তন করার একমাত্র টেকসই সমাধান ছিল এটাই।

কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্রের জন্য শক্তির বিকল্প উৎস ছিল প্রচলিত ব্যাটারির ব্যবহার। কিন্তু ব্যাটারির ব্যবহারের কিছু মারাত্মক অসুবিধা ছিল। এটি গরম হয়ে যেত। পাশাপাশি প্রতিদিন চার্জ দেওয়া লাগত। দুই বছরের বেশি টেকসই ছিল না ব্যাটারি। অন্যদিকে, পারমাণবিক শক্তিচালিত হৃদ্‌যন্ত্র ব্যবহার করা গেলে কোনো ধরনের চার্জ করা ছাড়াই রোগীকে ১০ বছর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা যেত।

পারমাণবিক এই হৃদ্‌যন্ত্রের শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল প্লুটোনিয়াম-২৩৮, যা প্রাকৃতিক উপায়ে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের ফলে শতবর্ষ ধরে স্থির মাত্রার তাপ নির্গত করতে পারে। কৃত্রিম উপগ্রহের শক্তি হিসেবে এ উপাদান ব্যবহার করা হয়। পপুলার সায়েন্সের তথ্য অনুযায়ী, উপাদানটি প্লুটোতে পাঠানো নভোযান নিউ হরাইজনস, ভয়েজার, এমনকি মার্স রোভার কিউরিওসিটিতেও ব্যবহার করা হয়েছে।

গবেষকেরা ভেবেছিলেন, পারমাণবিক শক্তি আহরণ করে মানবশরীরের ভেতরে রক্ত সঞ্চালন-প্রক্রিয়া চালু রাখতে পারবেন। কিন্তু অনেক কারিগরি সমস্যার মুখে পড়তে হয় তাঁদের। এমন একটি মেকানিক্যাল পাম্প তাঁদের তৈরির লক্ষ্য ছিল, যা মানবশরীর সহজে গ্রহণ করবে। এ ছাড়া এ যন্ত্র চালু রাখতে একটি নিরাপদ ও কার্যকর ইঞ্জিন যুক্ত করার দরকার ছিল, যা তাপশক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর করতে পারে।

এনএইচআই ও এইসি গবেষণার জন্য সেরাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাতে থাকে। এনএইচআই চেয়েছিল এমন একটি আংশিক হৃদ্‌যন্ত্র তৈরি করতে, যা অসুস্থ হৃদ্‌যন্ত্রকে চালু থাকতে সহযোগিতা করবে। এটি তৈরির জন্য শুরুতে ন্যানো-অ্যাটোমিক পাম্প সিস্টেম তৈরির প্রচেষ্টা চালায় এনএইচআই। পরে পারমাণবিক একটি ইঞ্জিন তৈরি করে তারা। অন্যদিকে, এইসি অ্যাটোমিক পাম্প ও ইঞ্জিন যুক্ত করে একটি হৃদ্‌যন্ত্র তৈরির চেষ্টা করে, যা অসুস্থ হৃদ্‌যন্ত্রকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হবে। পাঁচ বছর ধরে গবেষণা চালানোর পরও দুটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি হৃদ্‌যন্ত্রে কিছু ত্রুটি থেকে যায়। এইসির হৃদ্‌যন্ত্রটি যথেষ্ট কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি আর এনএইচআইয়ের হৃদ্‌যন্ত্রটিতে কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ে, যাতে যন্ত্রটি অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া কিংবা রক্ত জমাট বাঁধার মতো সমস্যা থেকে যায়।

এগুলো ছিল নকশাজনিত ত্রুটি। মানুষের শরীরের ভেতর এমন ভয়ংকর পারমাণবিক শক্তিচালিত কৃত্রিম যন্ত্র বসিয়ে দেওয়ার বিষয়টি চিন্তা করার আগে গবেষকেদের মূল্যবোধ ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে বিতর্ক ওঠে। কারণ অনেকে মনে করেন, এই কৃত্রিম হৃদয় লিউকেমিয়ার মতো অনেক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া আশপাশের অনেকেই তেজস্ক্রিয় বিষের ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারেন। আর এই কৃত্রিম হৃদয় যদি দুর্বৃত্তদের হাতে পড়ে, তবে তারা একে পারমাণবিক বোমাও বানিয়ে ফেলতে পারে। এক দশক পরেই গবেষকেদের ওই ধারণা মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে গবেষকেরা কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র তৈরির আশা একেবারেই ছেড়ে দেননি। অনেকগুলো বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম হৃদয় তৈরিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সিনকার্ডিয়া, কারনাট ও অ্যাবিওকরের মতো প্রতিষ্ঠান।

প্রযুক্তি-বিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য ভার্জের তথ্য অনুযায়ী, কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র তৈরির বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠানগুলো। অসুস্থ হৃদ্‌যন্ত্রের জায়গায় স্থায়ী ও কার্যকর কৃত্রিম হৃদয় বসিয়ে দেওয়া লক্ষ্য তাদের।

তবে পারমাণবিক হোক বা অন্য কোনো শক্তিচালিত হোক, দীর্ঘ মেয়াদে মানবশরীরে সহজে মানিয়ে যায় এবং বাড়তি কোনো ব্যাটারির দরকার পড়ে না, এমন হৃদ্‌যন্ত্রের নকশা করা এখনো বাকি। এখন পর্যন্ত যে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরি করা গেছে, তা মানুষের হৃদ্‌যন্ত্র প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত সময়টা রোগীকে টিকিয়ে রাখে। মানুষের হৃদ্‌যন্ত্রের হুবহু বা হৃদ্‌যন্ত্রের বদলি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, সে প্রযুক্তি হাতের নাগালে পেতে এখনো অনেক দূর যেতে হবে। সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার