পুকুরেও মিলবে স্বাদের ভেটকি!

ভেটকি মাছ। ছোট কিংবা বড়-আকৃতির—যেমনই হোক না কেন, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। ঝোল হোক কিংবা বারবিকিউ বা ভাজা, ফিশ সালাদ বা কাটলেট—ভেটকির স্বাদ জিবে লেগেই থাকে। তাই বোধ হয় এই মাছের কদর বেড়েই চলেছে রসনাবিলাসীদের কাছে। 

চ্যাপ্টা-লম্বা আকৃতির মাছটির দাম আকাশছোঁয়া। দক্ষিণাঞ্চলে ছোট একটি পোনার দামই এখন ১০ টাকা। একটু বড় পোনা ২০ থেকে ৩০ টাকায় কিনতে হয়। এক কেজি ওজনের ভেটকির দাম ৫০০ টাকা। ১০ থেকে ১২ কেজি কিংবা এর চেয়ে বড় ভেটকি কিনতে হলে সাধারণ ক্রেতার মুখ হয়তো মলিনই হয়ে যাবে।
তবে, মজাদার এই মাছ পাওয়া যায় কেবল দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার সাগরসংলগ্ন নদ-নদীর মতো জলাশয়গুলোতে। জোয়ারের স্রোতে এসব এলাকার মাছের ঘেরগুলোতেও চলে আসে ভেটকি। লোনাপানির এই মাছ এখন মিঠে পানিতেও চাষ সম্ভব হয়েছে। এমনকি পাঁচ-দশ কাঠা আয়তনের ছোট ছোট পুকুরে ভেটকি মাছ লালন-পালন করা যাবে।
খামারবাড়িতে আজ শুক্রবার বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে মাছের মেলায় তো তিন ফুট আকৃতির একটি অ্যাকুরিয়ামে দেখা গেল ছয়টি জীবন্ত ছোট ভেটকি মাছ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুদ্‌বুদ করে অক্সিজেন বের হচ্ছে সেই অ্যাকুরিয়ামে। এটি কীভাবে সম্ভব হয়েছে? জানতে চাইলে মৎস্য কর্মকর্তারা বলেন খুলনার পাইকগাছায় মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের লোনা পানি কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে।
এরপরই দুপুরে মুঠোফোনে কথা হয় লোনা পানি কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লতিফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন পাইকগাছায়। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল পুকুরের মতো ছোট জলাধারে ভেটকি মাছ চাষের যত নিয়মকানুন।
লতিফুল ইসলাম বলেন, সাগরের অতি লবণাক্ত পানির যে ধরনের পরিবেশ থাকে, তাতে করে ভেটকি মাছের পেটে ডিম আসে। সাগর ছেড়ে উপকূলের নদ-নদীতে এরা ডিম ছাড়ে। সেখান থেকে ভেটকির পোনা সংগ্রহ করা হয়। সেই পোনা নিয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর লোনাপানির কেন্দ্রে গবেষণা করেছেন লতিফুল ইসলাম। তাঁর মতে, যেকোনো পানিতে ভেটকি মাছ চাষ করা যাবে। ইচ্ছে করলে রাজশাহীর মতো এলাকার কোনো জলাধারে ভেটকি মাছ চাষ করা যায়। একজন খামারি যে ধরনের পানিতে চাষ করতে চাইবেন, সেই পানিতে এর চাষ করা যাবে। তবে এর আগে সেই পরিবেশ অনুযায়ী ভেটকি মাছকে উপযোগী করে তুলতে হবে। এ জন্য লোনাপানি থেকে আনার পর একই মাত্রার পানিতে রাখতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে মিঠা পানি ছেড়ে জলাধারের লবণাক্ততা দূর করতে হবে। একইভাবে কোনো খামারি যদি অতি লবণাক্ত পানিতে চাষ করতে চান, তাহলে তাঁকে একই ধরনের পদ্ধতি অনুযায়ী ভেটকির আবাসস্থল গড়ে তুলতে হবে।
লোনা পানির কেন্দ্রের বেশ কয়েকটি ছোট পুকুরকে লবণাক্ত করে ভেটকি মাছের চাষ করে আসছেন বলে জানালেন লতিফুল ইসলাম। ভেটকি মাছের প্রজনন এখনো পর্যন্ত বদ্ধ পরিবেশে করানো যায়নি। তবে, এ বিষয়ে দেশে গবেষণা চলছে।
যে জলাধারকে ভেটকি মাছ চাষের জন্য বেছে নেওয়া হবে, সেখানে অন্য ধরনের মাছ চাষ করা যাবে না বলে জানান লতিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রকৃতিগতভাবে ভেটকি মাছ জীবন্ত খাবার খেয়ে থাকে। তাই পুকুরে অন্য মাছ থাকলে সেগুলো এটি খেয়ে ফেলে। তবে, যেখানে ভেটকি চাষ করা হবে, তার পাশে আলাদা পুকুর করে সেখানে তেলাপিয়া-জাতীয় মাছ চাষ করতে হবে। সেখান থেকে মা ও পুরুষ তেলাপিয়া ভেটকি মাছ চাষের জন্য নির্ধারিত পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। তেলাপিয়া বংশবৃদ্ধি করার পর সেখানে ভেটকির পোনা ছাড়তে হবে। গড়ে দুই বর্গমিটারের কিছু কম জায়গায় একটি ভেটকি মাছ চাষ করা যায়। যতটা কম ঘনত্বে রাখা যায়, ততটাই এই মাছের বৃদ্ধির জন্য মঙ্গল। কারণ, ছোট অবস্থায় একটি ভেটকির যে পরিমাণ ওজন থাকে, ঠিক একই পরিমাণ খাবার ওর প্রয়োজন হয়। একটি ভেটকির পোনা ছয় মাসে এক কেজি ওজন হয়ে থাকে। তাই ভেটকি মাছ চাষ তুলনামূলক ব্যয়বহুল।
ব্যয়বহুল হলেও ভেটকি মাছ চাষ লাভজনক বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সি-ফুড হিসেবে বিদেশে চিংড়ি বা ভেটকি মাছকে বোঝে। এসব মাছে গন্ধ হয় না। পর্যটকদের কাছে এর চাহিদা রয়েছে। ভেটকি মাছ চাষে ভারত, থাইল্যান্ড সাফল্য পেয়েছে। ব্লু ইকোনমির (সমুদ্র অর্থনীতি) সাফল্যের জন্য ভারত-থাইল্যান্ডের মতো গবেষণা আমাদের দেশে প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন অন্য মাছের সঙ্গে সমন্বিতভাবে ভেটকি মাছ চাষ করার বিষয়টি।