হাত বাড়ালেই ইলিশ!

‘মাছটা ধরেন, তেল কত! ১২০০ টাকা কেজি পড়ব।’ বড়সড় একটি ইলিশ হাতে ধরাতে চাইলেন দেলোয়ার হোসেন। অন্যদিকে ঘুরতেই আবার ডাক দেলোয়ারের, ‘আপনে যদি লন, একদাম ১০০০ টাকা। ভাই, আপনে শুধু মাছটা ধরেন। ঘাড়ে কত তেল, কত মোটা! একটা ইলিশ এক কেজি তো হইবোই।’

ইলিশের ঝুড়ি নিয়ে বসে এভাবে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা দেলোয়ারের। একের পর এক ইলিশ তুলছেন দুহাতে। ক্রেতারা কিনছেন ঠিকই, তবে আয়েশ করে। চারদিকে কত্ত ইলিশ! দেখেশুনে একটু কম দামে কিনছেন পছন্দের ইলিশ।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাছের আড়তের সামনে পুরো ফুটপাত আজ বৃহস্পতিবার ভরদুপুরেও দেলোয়ারের মতো ইলিশ বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত ছিল। অথচ এই মাছের বাজারের আড়তগুলোয় অন্য সময় সকাল ১০টার পরই বেচাকেনার পর্ব শেষ হয়ে যায়। ইলিশ বিক্রেতাদের মুখে চড়া দাম শুনে মোটেও বিচলিত নন ক্রেতারা। কারণ, এখানে ইলিশ-ভর্তি অসংখ্য ঝুড়ি সাজানো ছিল। তাই বিক্রেতাদের জোরাজুরির শেষ নেই। এতে ক্রেতারা দরদাম করে আরাম পাচ্ছেন। আরে, এখন হাত বাড়ালেই ইলিশ!
দামে রকমফের: প্রায় সাত দিন ধরে ইলিশ যেন এভাবে উপচে পড়ছে কারওয়ান বাজারের আড়তগুলোয়। ভোর গড়িয়ে সকাল এলেও ইলিশ ফুরায় না। ইলিশ আসছে তো আসছেই। ইলিশ না ফুরোনোর কারণে দেলোয়ারের মতো খুচরা বিক্রেতা আড়ত থেকে চলে আসছেন ফুটপাতে।

এখানে বিভিন্ন আকারের ইলিশ মিলছে। ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ৮০০ টাকা। ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম আরও কম। অনেকে আবার হালি হিসেবে ইলিশ বিক্রি করছেন।

আরেক বিক্রেতা চারটি ইলিশের দাম চাইলেন দুই হাজার টাকা। হাত দিয়ে বারবার ইলিশ মুছতে মুছতে তিনি দাবি করেন, চারটি ইলিশের ওজন হবে সাড়ে তিন কেজি। তবে ওজন করে দেখা যায়, চারটি ইলিশের দুই কেজির কিছু বেশি।

একজন আবার ইলিশের মুখ খুলে দেখান এক ক্রেতাকে। তাঁর দাবি, ইলিশগুলো পদ্মার।

ইলিশ মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে নদ-নদী থেকে: বরিশালসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে এখন ইলিশ আসছে বেশি। কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন মাছের আড়তগুলো ঘুরে এমন তথ্যই জানা গেছে। মো. শিপন নামে এক আড়তদার জানান, বরিশাল ছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে ইলিশ আসছে। আগের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি ইলিশ আসছে ঢাকার বাজারে। এসব ইলিশ ধরা পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। পদ্মা তো নয়ই, দক্ষিণের নদ-নদীগুলোয় এখনো ইলিশের আকালই রয়ে গেছে।

প্রথম আলোর পিরোজপুর প্রতিনিধি এ কে এম ফয়সাল কথা বলেছেন সেখানকার জেলেদের সঙ্গে। জেলেরা জানান, সাগরে পুবালি (পূর্ব) বাতাস বা ঝড় হলে ইলিশ নদ-নদীতে চলে আসে। এ বছর সাগরে পুবালি বাতাস এখনো শুরু না হওয়ায় নদ-নদীতে ইলিশ মিলছে না। এখন ইলিশের মৌসুম হলেও বলেশ্বর নদ, কচা, বিষখালী ও পায়রা নদীতে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না।

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে পিরোজপুরের বাজারে ইলিশের দামের ব্যবধানও খুব একটা নেই। বরগুনা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। এ কারণে সাগরের ইলিশের দাম কিছুটা কম। তবে নদ-নদীতে ইলিশ খুবই কম মিলছে। তাই নদীর ইলিশের দাম বেশি। সাগরে ধরা পড়া বরফ দেওয়া ইলিশ ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি। আর নদীতে ধরা পড়া ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ইলিশ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এক কেজি ওজনের ইলিশ ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হয়। নদ-নদীতে ইলিশ কম ধরা পড়ায় এ বছর ইলিশের ভরা মৌসুমে দাম কমেনি।

শুধু পুবালি বাতাস নয়, স্রোতের কারণে নদী ঢুকতে পারছে না ইলিশ। তাই সাগর, সাগরের মোহনায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। এমন মন্তব্য মৎস্য বিশেষজ্ঞদের।

মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অন্যান্য বছর এ সময় দেশের নদ-নদীগুলোয় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। তবে এবারের বর্ষা বড় বিচিত্রের ও দীর্ঘ স্থায়ী হচ্ছে। উজানে নদ-নদীতে প্রচুর স্রোত বইছে সাগরের দিকে। স্রোতের বাধার কারণে ইলিশ নদীতে যেতে পারছে না। এখন বাজারে যেসব ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রায় সবই সাগর থেকে ধরা পড়েছে।

ইলিশ-ভর্তি ঝুড়ি। এভাবে সাজানো ইলিশ দেখা গেল বৃহস্পতিবার দুপুরে কারওয়ান বাজার মাছের আড়তের পাশে ফুটপাতে। ছবি: কমল জোহা খান
ইলিশ-ভর্তি ঝুড়ি। এভাবে সাজানো ইলিশ দেখা গেল বৃহস্পতিবার দুপুরে কারওয়ান বাজার মাছের আড়তের পাশে ফুটপাতে। ছবি: কমল জোহা খান

সাগর-নদী পার্থক্য গড়ে ইলিশের স্বাদ-আকারে: পিরোজপুরের বলেশ্বর নদে মাছ ধরেন আবদুর রাজ্জাক নামে এক জেলে। ইঞ্জিনের নৌকা নিয়ে বরগুনা হয়ে সাগরেও চলে যান তিনি। আবদুর রাজ্জাক বলেন, সাগরের ইলিশ লম্বাটে হয়। লবণ পানিতে থাকায় এদের শরীরে তেল কম থাকে। কিন্তু বলেশ্বরের ইলিশ খানিকটা গোলাকৃতির ও রুপালি ভাব বেশি থাকায় উজ্জ্বল হয়। নদীর মিঠাপানিতে থাকায় এরা খেতেও সুস্বাদু। স্বাদের কারণে নদীর ইলিশের দামও বেশি।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানান, নদীতে ইলিশ প্রচুর খাবার খায়। এতে এদের শরীরে তেল জমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদীতে আসার সময় ইলিশ প্রচুর সাঁতার কাটে। সাধারণত ইলিশ ছোট থাকা অবস্থায় প্রাণিজ প্লাঙ্কটন ও উদ্ভিজ্জ প্লাঙ্কটন খেয়ে থাকে। কিন্তু বড় হওয়ার সময় সে উদ্ভিজ্জ প্লাঙ্কটনের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে। মেঘনা নদীতে শৈবালজাতীয় উদ্ভিজ্জ প্লাঙ্কটন প্রচুর পাওয়া যায়। এই উদ্ভিজ্জ প্লাঙ্কটন খাওয়ায় ইলিশের স্বাদ বেড়ে যায়। ইলিশের প্রজননে এটিই আমাদের আশীর্বাদ।’

সাগর থেকে ইলিশ ঘণ্টায় প্রায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে নদীতে আসে। আর এ দেশের নদীতে ইলিশ তার প্রয়োজনীয় খাবার পেয়ে থাকে। তবে দীর্ঘ সময় সাঁতার কাটায় ইলিশের আকার বদলে যায় বলে জানান মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, নদীর ইলিশের পিঠের দিকটা কালচে ও পুরু হয়। নদীর পানি ঘোলা হলে ইলিশের পিঠে কালচে রং কম হয়। কিন্তু নদীর পানি স্বচ্ছ হলে কালচে ভাব বেড়ে যায়। কারণ ইলিশ মনে করে, স্বচ্ছ পানিতে তাকে দেখা যেতে পারে। তাই সে নিজেও রং-রূপ বদলাতে পারে।

সাগর কিংবা নদী, যেখানেই ধরা পড়ুক না কেন, এই মৌসুমে ইলিশ উৎপাদন বাড়বে জানিয়ে শেখ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগেরবার ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল ৩ লাখ ৯৭ মেট্রিক টন। এবার এটি হতে পারে পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি।