শৌচাগারের জন্য এত ভোগান্তি

আনিকা রহমান ও আশরাফুন নাহার হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। আজ বুধবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এক নাগরিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে এই দুই নারী বিপাকে পড়েন। তাঁরা তাঁদের হুইলচেয়ার নিয়ে কিছুতেই শৌচাগারে ঢুকতে পারছিলেন না। অথচ খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট কমপ্লেক্সে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধী নারীদের প্রবেশগম্য করে শৌচাগার তৈরি করা রয়েছে। কিন্তু ওই শৌচাগার স্টোর রুম বানিয়ে তালা দেওয়া।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ এই নাগরিক সম্মেলনের আয়োজন করে।

সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্টের (সিডিডি) অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর (প্রশিক্ষণ) আনিকা রহমান এই সম্মেলনে যোগ দিতে সকাল সাতটায় সাভার থেকে রওনা হন। বেলা দুইটা পর্যন্ত তিনি শৌচাগারে যেতে পারেননি।

উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার সকাল থেকে কয়েকবার শৌচাগারে ঢুঁ দিয়েছেন। কেআইবি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কোনো উপায় না দেখে নারীদের প্রসাধন কক্ষ থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে শৌচাগারের দরজা খোলা রেখে ক্যাথাটারের সাহায্যে প্রস্রাব করেছেন।

আজকের নাগরিক সম্মেলনের মূল কথা ছিল ‘কাউকে পিছিয়ে রাখা যাবে না’। ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য মানসম্পন্ন জীবনযাপনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

দুপুরে সামাজিক প্রসঙ্গ নিয়ে সমান্তরাল অধিবেশনে অংশ নেন আনিকা রহমান ও আশরাফুন নাহার। প্যানেল আলোচকেরা আলোচনায় বলেন, কাউকে পিছিয়ে রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেখানে উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে আশরাফুন নাহার কেআইবি কমপ্লেক্সে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য তৈরি শৌচাগার তালাবদ্ধ করে রাখার বিষয়টি জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

অধিবেশন শেষে এই দুই নারীর সঙ্গে শৌচাগারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অনেকগুলো শৌচাগারের মধ্যে অনেক বড় করে বানানো যে শৌচাগারটি তা তালাবদ্ধ।

আনিকা রহমান জানালেন, এর আগে এখানেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বড় একটি সম্মেলন হয়েছিল, তখন এ শৌচাগারের সামনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যে প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তা-ও ছিল। কিন্তু এখন তা-ও তুলে ফেলা হয়েছে।

আনিকা রহমানের হুইলচেয়ার অন্য শৌচাগারের ভেতরে ঢোকে, তবে তারপর আর দরজা লাগানো যায়নি। তিনি অন্য একজনের সহায়তায় শৌচাগারের দরজা থেকেই হুইলচেয়ার বাইরে রেখে ভেতরে ঢোকেন। কিন্তু শৌচাগারের ভেতরে ধরার জন্য কোনো কিছু না থাকায় তিনি ভারসাম্য রাখতে না পেরে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন বলে জানালেন প্রতিবেদককে। শৌচাগার থেকে বের হওয়ার সময় আবার তাঁকে অন্যজনের সহায়তা নিতে হয়।

আনিকা বলেন, ‘এখন টয়লেট না করতে পারলে আমাকে সম্মেলন শেষ না করেই বাড়ির পথ ধরতে হতো। সারা দিন তো আর টয়লেট না করে থাকা যায় না।’

আশরাফুন নাহারের ভোগান্তির মাত্রা বেশি ছিল। তাঁর হুইলচেয়ার বড়, তাই তা নিয়ে কোনোভাবেই শৌচাগারের দরজার কাছ পর্যন্তই যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি প্রসাধন কক্ষ থেকে সবাইকে বাইরে চলে যাওয়ার অনুরোধ করেন। পরে প্লাস্টিকের বোতল ও ক্যাথাটারের সাহায্যে কোনোভাবে প্রস্রাব করেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই ভবনে আমাদের জন্য টয়লেট আছে, তারপরও আমাদের এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এটি হলো কর্তৃপক্ষের আমাদের প্রতি চরম অবহেলার উদাহরণ। কর্তৃপক্ষ ধরেই নিয়েছে, হুইলচেয়ার নিয়ে কোনো নারী এখানে আসবে না। তাই আমাদের টয়লেটকে স্টোর রুম বানিয়েছে।’

একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে শৌচাগারের তালা খুলতে বললে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি তালা খোলেন। দেখা গেল, কমোডের ওপর থেকে শুরু করে প্রায় পুরো জায়গাতেই বিভিন্ন জিনিস রাখা আছে। কোনোভাবেই সেই জায়গাটিকে শৌচাগার বলার আর উপায় নেই।

তবে পাশেই পুরুষদের প্রসাধন কক্ষ, সেখানে হুইলচেয়ার নিয়ে ঢোকা যাবে, সে ধরনের শৌচাগারটি খোলা আছে। আশরাফুন নাহার প্রতিবেদককে দেখানোর জন্য সেখানে তাঁর হুইলচেয়ার নিয়ে খুব সহজেই ঢুকে গেলেন। তবে এখানেও ধরার জন্য কোনো হ্যান্ডেল নেই।

সরকারি স্থাপনা কেআইবি কমপ্লেক্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষিবিদ জুবায়েদ আল হাফিজ প্রথম আলোর কাছ থেকে শৌচাগার তালাবদ্ধ করে রাখার অভিযোগ শুনে সঙ্গে সঙ্গে তা খুলে ব্যবহার উপযোগী করার নির্দেশ দেন। এ ধরনের ঘটনায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি প্রতিবেদকের সামনেই টেলিফোন করে জানেন, তাঁদের তালিকাভুক্ত ইকবাল হোসেন ক্যাটারিং শৌচাগারটিকে স্টোর বানিয়ে তালা দিয়ে রেখেছিল।

জুবায়েদ আল হাফিজ বলেন, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বানানো টয়লেটকে স্টোর বানানো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।’