বব ডিলান ও দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

>

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করছেন জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করছেন জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের সংগীত জগতে নতুন কাব্যিক ধারা সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বব ডিলান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন বব ডিলান। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট পণ্ডিত রবিশংকর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এই অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। বাংলাদেশের বন্ধু নোবেল বিজয়ী বব ডিলানকে নিয়ে এবারের প্রচ্ছদ আয়োজন।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশে গান গাইছেন জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও লিওন রাসেল
কনসার্ট ফর বাংলাদেশে গান গাইছেন জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও লিওন রাসেল

২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন মার্কিন কবি, গীতিকার ও গায়ক বব ডিলান। গত বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর, ২০১৬) বিকেলে প্রথম আলো অফিসে সুমনা শারমীনের কাছ থেকে এ সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই গভীর আবেগে মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাহায্যে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর কথা। সেদিনের অনুষ্ঠানের এক বড় তারকা ছিলেন বব ডিলান। নিউইয়র্কের সেই সংগীতানুষ্ঠান আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি ও শরণার্থীদের সাহায্যে তহবিল গঠনে এক বিরাট ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল। সত্যিকার অর্থে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার বিরুদ্ধে আর মানবিকতার সপক্ষে যে বড় বড় সংগীতানুষ্ঠান হয়ে থাকে, আসলে তা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের সমর্থনে সেই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ থেকেই।

আমরা জানি, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য তহবিল সংগ্রহে বিশ্বশ্রেষ্ঠ সেতারবাদক রবিশঙ্কর এক অনুষ্ঠান করতে বিটলস গায়ক জর্জ হ্যারিসনকে অনুরোধ করেছিলেন। জর্জ হ্যারিসনও তাঁর অনুরোধে সম্মতি জানান। তবে তাঁকে স্বল্প সময়ের মধ্যেই প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল এই অনুষ্ঠান করতে। অনুষ্ঠানের জন্য ১ আগস্ট ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন খালি পাওয়া যায়। তারপর একদিকে কনসার্টের নানা প্রস্তুতি এবং অন্যদিকে শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়ে যায়। জর্জ হ্যারিসনের ভাবনায় ছিল যে এই সময়টাই সঠিক। কারণ, প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছিল এবং মার্কিন সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছিল।

জর্জ হ্যারিসন যখন ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তখন বিটলস গ্রুপ ভেঙে গেছে। বিটলসের সহশিল্পীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বস্তিকর ছিল না। তা সত্ত্বেও জর্জ হ্যারিসন আত্মাভিমান ত্যাগ করে সহশিল্পী ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। বিটলসের ড্রামার রিঙ্গো স্টার রাজি হয়েছিলেন এককথায়। জনপ্রিয় গায়ক লিওন রাসেল ও বিল প্রেস্টন প্রথম প্রস্তাবেই সম্মতি জানান। এরিক ক্ল্যাপটন প্রস্তাবটি বিবেচনার আশ্বাস দেন। তবে সে সময়ের প্রবল প্রভাবশালী গায়ক বব ডিলান সম্মতি জানাতে সময় নেন। বলা যায়, প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত অনিশ্চয়তা ছিল বব ডিলানের অংশগ্রহণের বিষয়টি। তবে শেষ পর্যন্ত বব ডিলান অংশ নিয়েছিলেন। তাঁকে পেয়ে জর্জ হ্যারিসন আনন্দিত হয়েছিলেন।

জর্জ হ্যারিসনের বই আই-মি-মাইন থেকে জানা যায়, অনুষ্ঠানের আগে সব শিল্পীর পুরো রিহার্সেলও হয়নি। অনুষ্ঠানের আলোর ব্যবস্থা ভালো ছিল না। তথ্যচিত্র ধারণের ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত ছিল না। এই সবকিছুর পর অনুষ্ঠানটি এক দিন দুবার হয়েছিল। কারণ, প্রথমটির সব টিকিট দ্রুতই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।

জর্জ হ্যারিসন অনুষ্ঠানের হাজার হাজার শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরুতেই বলেন, ‘ভারতীয় সংগীত আমাদের চেয়ে অনেক গভীর।’ তারপর পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান ও সহশিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেন। কনসার্টের শুরুতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলেন, ‘প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাদনে শুধু সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব “বাংলা ধুন”।’

দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান আর জর্জ হ্যারিসন। সে অনুষ্ঠানে বব ডিলান পাঁচটি গান গেয়েছিলেন। বব ডিলানের জনপ্রিয় গানগুলো শুনতে পেরে দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। তাঁর গানগুলো ছিল: ১. আ হার্ড রেইনস গনা ফল ২. ইট টেকস আ লট টু লাফ/ইট টেকস আ ট্রেন টু ক্রাই ৩. ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড ৪. মি. টাম্বুরিন ম্যান এবং ৫. জাস্ট লাইক আ ওম্যান। প্রতিটি গানের সঙ্গে বব ডিলান অ্যাকুস্টিক গিটার ও হারমোনিকা বাজিয়েছিলেন। আর প্রতিটি গানের সঙ্গে জর্জ হ্যারিসন ইলেকট্রিক গিটার বাজান। বিটলসের আরেক সদস্য রিঙ্গো স্টার বাজিয়েছেন টাম্বুরিন। আর প্রতিটি গানের সঙ্গে বাস নিয়ে সঙ্গী ছিলেন লিওন রাসেল। তবে বব ডিলানের শেষ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে সঙ্গী হয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন ও লিওন রাসেল।

দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের বব ডিলানের পাঁচটি গানই লং প্লে​িয়ং (এলপি) রেকর্ড ও বিশেষভাবে সিডিতে পাওয়া যায়। তবে ২০০৫ সালে নতুন করে প্রকাশিত দুটি ডিভিডিতে বব ডিলানের গান রয়েছে চারটি। শুধু ‘মি. টাম্বুরিন ম্যান’ গানটি নেই।

২০০৫ সালে পুনঃপ্রচারিত দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ডিভিডি প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকায় ইউএসএ ফান্ড ফর ইউনিসেফের সভাপতি চার্লস জে লিওনসের লেখা থেকে জানা যায়, কনসার্টের টিকিট বিক্রি থেকে সংগ্রহ হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ ডলার।

দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আয়োজন আর সংগীত আজও বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও প্রচারিত। ২০০৫ সালে নতুন করে ডিভিডির বিক্রি থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দ্য জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ, যা হ্যারিসন পরিবার ও ইউএস ফান্ড ফর ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুদের জরুরি স্বাস্থ্য বিষয়ে সহায়তা দান করছে। এই ‘জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ’-এর প্রতিষ্ঠাতা জর্জের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিন দিনের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ওই কনসার্ট করতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল জর্জ হ্যারিসনের।

অলিভিয়া হ্যারিসন ঢাকায় অবস্থানকালে ইউনিসেফের সহযোগিতায় যেসব কাজ চলছে, সেগুলো দেখতে এসেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিশুদের জন্য কিছু কর্মসূচি চলে জর্জ হ্যারিসন ফান্ডের সহায়তায়। আরও কিছু কাজ নিয়েও তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল ঢাকার ইউনিসেফের অফিসের সঙ্গে।

আসলেই, ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সংগৃহীত তহবিলের কাজ এখন চলছে বাংলাদেশে। এটা বড় এক অনুপ্রেরণা। সে জন্যই আমরা আজ বিশেষভাবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বব ডিলানকে স্মরণ করছি। একই সঙ্গে স্মরণ করছি পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনকে। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে তাঁরা অমর।