কারাগার থেকে গবেষণাগার

মতলবের এই বার্জে বসেই খাওয়ার স্যালাইন নিয়ে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। ছবি: আইসিডিডিআরবি
মতলবের এই বার্জে বসেই খাওয়ার স্যালাইন নিয়ে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। ছবি: আইসিডিডিআরবি

বার্জটি ছিল ভাসমান কারাগার। একসময় নৌ-ডাকাতদের ধরে এই বার্জে আটক করে রাখতেন ব্রিটিশ শাসকেরা। এটিকে ভাসমান কারাগার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ১৯৬৪ সাল থেকে এটি আইসিডিডিআরবির কলেরা চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। বর্তমান পৃথিবীর বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী এই বার্জে থেকেছেন এবং গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এটিকে এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহারের চিন্তা করছে কর্তৃপক্ষ।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) কলেরা গবেষণার জন্য চাঁদপুরের মতলব এলাকাকে বেছে নেয়। স্থানীয়ভাবে জমি ও ভবন পাওয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় নারায়ণগঞ্জ থেকে পরিত্যক্ত একটি বার্জ নিয়ে যাওয়া হয়। বার্জের নিচতলায় খোলা হয় হাসপাতাল।

আইসিডিডিআরবির ইমেরিটাস বিজ্ঞানী মো. ইউনূস ষাটের দশকে আইসিডিডিআরবিতে যোগ দেন। শুরুতে তাঁর কর্মস্থল ছিল মতলব। মো. ইউনূস বলেন, শুরুর দিকে যখন হাসপাতালের জন্য জমি পাওয়া কঠিন হচ্ছিল, তখন খবর পাওয়া যায় ব্রিটিশদের পরিত্যক্ত একটি বার্জ নারায়ণগঞ্জ বন্দরে রয়েছে। সরকার ওই বার্জটি নেওয়ার অনুমতি দেয়।

একসময় পদ্মা-মেঘনার মোহনায় ডাকাতদের ব্যাপক উপদ্রব ছিল। আন্তজেলা ডাকাতি মোকাবিলায় ব্রিটিশ পুলিশ নদীপথে টহল দিত। বার্জটি থাকত মেঘনা নদীতে। ধরতে পারলে পুলিশ ডাকাতদের এই বার্জে রাখত, এমনই জানালেন মো. ইউনূস। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে চলে গেলে বার্জটি পাকিস্তানের সম্পত্তি হয়।

১৯৬৪ সালে বার্জটি আনা হয় মতলবে। রাখা হয় গোমতির শাখা নদী ধনাগদায়। কলেরা রোগীদের চিকিৎসায় বার্জের নিচতলায় ছয় শয্যার হাসপাতাল চালু করা হয়। দোতলায় গবেষণাগার ও বিজ্ঞানীদের থাকার ব্যবস্থা।

নদীনালা আর জলাভূমির আধিক্যের কারণে মতলব অঞ্চলে কলেরার প্রকোপ বেশি ছিল। নৌকায় করে লোকজন সোজা চলে আসতেন ভাসমান হাসপাতালে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি স্পিডবোট ছিল আইসিডিডিআরবির। দ্রুত রোগী আনার কাজে সেগুলো ব্যবহার করা হতো। ১৯৬৬ সালে হাসপাতাল স্থানান্তর হওয়ার পর বার্জটি ‘গেস্টহাউস’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।

আইসিডিডিআরবির যুগান্তকারী আবিষ্কার খাওয়ার স্যালাইন। এই আবিষ্কারের প্রধান বিজ্ঞানী ডেভিড নেলিন, মজিদ মোল্লা ও জন রোলে—এ তিনজনই এই বার্জের গেস্টহাউসে থেকে গবেষণা করেছেন। বর্তমান সময়ের খ্যাতিমান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ডেভিড সেক, রিচার্ড ক্যাস, হেনরি মজলে, বব ব্লাক, লিঙ্কন চেন এই বার্জ ব্যবহার করেছেন। আইসিডিডিআরবির বর্তমান নির্বাহী পরিচালক জন ক্লেম্যান ১৯৮৫ সালের দিকে কলেরার ওরাল ভ্যাকসিন বা মুখে খাওয়ার টিকা পরীক্ষার গবেষণার সময় এই বার্জে অবস্থান করেছেন।

 ১৯৯০ সালে আইসিডিডিআরবির নিজস্ব ভবনে হাসপাতাল ও গবেষণাগার স্থানান্তর করা হয়। তখনো বার্জটি নদীতেই ছিল। এলাকার লোকজন কলেরা হাসপাতাল বলতে ওই বার্জকেই বুঝতেন।

আইসিডিডিআরবির মতলব কেন্দ্র দেখতে গেলে এই বার্জটি বিশেষ যত্ন নিয়ে দেখানো হয়। গত ৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে নিরাপত্তাকর্মী এই প্রতিবেদকের জন্য বার্জের তালা খুলে দেন। আইসিডিডিআরবির কর্মকর্তারা লোহার গারদ দেখিয়ে বলেন, সেখানে ডাকাতদের আটকে রাখা হতো। পরে দোতলায় ছিল বিজ্ঞানীদের থাকার ঘর। প্রতিটি খাট দ্বিতল। ঢাকায় ফিরে এসে বার্জের পুরো ইতিহাস জানা গেল ইমেরিটাস বিজ্ঞানী মো. ইউনূসের কাছে। এই প্রবীণ বিজ্ঞানী বলেন, বার্জটি এখন প্রতীক।