'ট্যাবু' ভাঙছেন যে তরুণেরা

এই তিন তরুণের হাত ধরে এসেছে সফল একটি উদ্যোগ
এই তিন তরুণের হাত ধরে এসেছে সফল একটি উদ্যোগ

নোয়াখালীর জমিদারহাট বি এন উচ্চবিদ্যালয়। ঢাকা থেকে চার হাজার স্যানিটারি প্যাড বা ন্যাপকিন পাঠানো হয়েছে। মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, কে পাঠাল? এগুলো পাঠিয়েছেন পেশায় প্রকৌশলী তারেক হাসান, চিকিৎসক শাকির ইব্রাহিম ও একটি অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিক মারজিয়া প্রভা। কিন্তু কেন?

অবিবাহিত এই তিন তরুণ চাচ্ছেন মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার নিয়ে যে ‘ট্যাবু’ বা গোপনীয়তা আছে, তা ভাঙতে। আর কাজটি করছেন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো, নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে। বেতনে না কুলালে অনেক সময় ধারদেনা করেন। অনেক সময় পরিবারের সদস্যরাও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের কার্যক্রমের নাম ‘ডোনেট এ প্যাড ফর হাইজিন বাংলাদেশ’।

৭ ডিসেম্বর কথা হলো এই তিন তরুণের সঙ্গে। জানালেন প্রথম দিকে পরিবার আর এখন সমাজের নানাজনের নানা কথা শুনতে হচ্ছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছেন অনেকেই। অনেকে আবার বাহবাও দিচ্ছেন। মেয়েরা না হয় এই লজ্জাজনক বিষয়টি নিয়ে কথা বলল, কিন্তু তাই বলে অবিবাহিত দুই তরুণও এ নিয়ে কথা বলবে, এ কেমন কথা? তাঁদের কি লজ্জাশরমের বালাই নাই? অনেকে এই দুজনের পুরুষত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলতে ছাড়েননি। তবে তরুণেরা দমে যাওয়ার পাত্র নন। এরই মধ্যে তাঁরা ছোট মেয়ে পাখির গল্প দিয়ে একটি সচিত্র কমিক তৈরি করেছেন। সমাজের সেলিব্রেটিরা এ কার্যক্রম নিয়ে কথা বলেছেন, কোনো স্কুলে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই কমিক দেওয়া হয় এবং ওই ভিডিও দেখানো হয়।

জমিদারহাট বি এন উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত মে মাস থেকে বিনা মূল্যে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করছে। স্কুল থেকে যে চাহিদা চাওয়া হয়, তা এবার চার হাজার পিসে গিয়ে ঠেকেছে। স্কুলের ছেলে শিক্ষার্থীরা প্রথম দিকে ঢিল ছুড়ত, হাসাহাসি করত। এখন তারাই বাসস্ট্যান্ড থেকে প্যাডের প্যাকেট আনাসহ নানা কাজে সহায়তা করছে। শিক্ষার্থীদের বাইরে তাদের মা, খালা, বোনসহ পরিবারের অন্য নারীরাও উৎসাহী হয়ে উঠছেন। মারজিয়া প্রভাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো, প্যাড ব্যবহারে উৎসাহী করে তোলা। বিষয়টি একজন মেয়ে বা নারীর স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকু জরুরি, তা বুঝতে পারলে বাজার থেকে কিনে হলেও প্যাড ব্যবহার করবে। বর্তমানে অনেক বাবা, স্বামী নিজের সিগারেটের পেছনে টাকা খরচ করলেও প্যাড কেনার বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না। তবে নোয়াখালীর ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের অনেক পুরুষ অভিভাবক এখন নিজে থেকেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আসেন। অনেকে চুপি চুপি এসে স্ত্রীর জন্য প্যাড কিনবেন বলে জানান।

ট্যাবু ভাঙার কাজটি কি এতই সহজ? এই প্রশ্নের উত্তরে তিন তরুণই মাথা ঝাঁকালেন। এমনও হয়েছে, প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে সভা শুরু করার পরও কোনো কোনো জায়গায় স্থানীয় নেতাদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। অনেকটা পাহারার মধ্যে থেকে আলোচনা শেষ করতে হয়েছে। কেননা ঢাকার ছেলেমেয়েরা গ্রামের মেয়েদের নিশ্চয়ই খারাপ কথা শেখাচ্ছে। ঘর থেকে বাইরে বের করার উসকানি দিচ্ছে।

তারেক হাসান ও শাকির ইব্রাহিম আগে থেকেই নানান সামাজিক উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গত বছর একটি মেডিকেল ক্যাম্পে গিয়ে পরিচয় হয় মারজিয়া প্রভার সঙ্গে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওই মেডিকেল ক্যাম্পে সেবা নিতে আসা নারীদের সঙ্গে কথা বলেন প্রভা। লজ্জায় মাসিকের সময় যে কাপড় ব্যবহার করেন, তা-ও রোদে শুকাতে দেন না। অনেকে মাসিকের সময় পেটিকোটে রক্ত লাগলে নদীতে ডুব দিয়ে ধুয়ে ফেলেন। মাসিকের সময় নারীদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা শোনেন। তারপরই প্রভা বিষয়টি তারেক ও শাকিরের সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রথম দিকে দুই তরুণ লজ্জায় বেশ বিপাকেই পড়ে যান। তবে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেই তাঁরা হ্যাঁ করেন। ৩০ বা বেশি বয়সী নারীদের সচেতন করার কাজটি কঠিন, তাই তাঁরা শিক্ষার্থীদের সচেতন করার বিষয়টিতে জোর দেন।

তারেক ও শাকির জানালেন, প্রথম দিকে পরিবারের সদস্যরা তীব্র আপত্তি জানান। ছেলে গ্রামে গিয়ে স্যানিটারি প্যাড নিয়ে কথা বলছে, ঢাকা থেকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে প্যাড কিনে বাসে করে প্রতি মাসে এলাকায় পাঠাচ্ছে, এ কেমন কথা? তবে এখন পরিস্থিতি উল্টো।

শাকির বলেন, ‘প্রভার সঙ্গে কথা বলার পরপরই একটি ঘটনা নজরে আসে। নিজের ছোট বোন স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি ফার্মেসিতে ঢোকে, ফার্মেসির লোকটি কেমন যেন হাসি দেয়। বোন প্যাডের প্যাকেটটি নিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়। তা দেখে খুব খারাপ লাগে। আর এখন মাসের প্রথমেই বোনের জন্য একটি প্যাকেট নিজে কিনে দিই।’

তারেকের বাড়ি নোয়াখালীতে। জমিদারহাট বি এন উচ্চবিদ্যালয়ে নিজের বোন পড়ছে। ও এ কার্যক্রমে আরেকজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে। আর আপন ছোট ভাই প্যাডের প্যাকেট স্কুল পর্যন্ত পৌঁছানোসহ নানান কাজে সহায়তা করছে। মারজিয়া প্রভার বাবা শুরুতে নাখোশ ছিলেন। এখন আর কোনো সমস্যা নেই।

ডোনেট এ প্যাড ফর হাইজিন বাংলাদেশ নামের কার্যক্রমে চিকিৎসক নাজিয়া বিনতে আলমগীর, কামরুন নাহার, মাহমুদা শিকদার নিজেদের দায়বোধ থেকেই যুক্ত হয়েছেন। বিভিন্ন স্কুলের আলোচনা সভায় মেয়েদের মাসিক-সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেন তাঁরা।

মারজিয়া প্রভা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তিনজন মিলে মাসে ১৫ হাজার টাকা আলাদা করে রাখি। একটি টেক্সটাইল কোম্পানির বানানো প্যাড আমরা কিনছি। প্যাকেটপ্রতি দাম পড়ছে ৩০ টাকা করে। প্যাডগুলো আসলেই মেয়েদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত কি না, তার জন্য নিজে এবং নিজেদের পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করতে দিচ্ছি। চিকিৎসকদের কাছ থেকেও মতামত নেওয়া হয়েছে।’

এই তিন তরুণ একটি স্কুলের মধ্যেই আটকে থাকতে চান না, তাঁরা নোয়াখালীর সব কটি স্কুলে এ কার্যক্রম চালাতে চাচ্ছেন। তারপর আস্তে আস্তে অন্য এলাকায়। কিছুটা ক্ষীণ স্বরেই তিন তরুণের বক্তব্য: সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা যদি একটু এগিয়ে আসেন, তাহলে গ্রামের মেয়েদের অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারের ফলে সাদা স্রাবসহ যে নানান জটিলতা হচ্ছে, তা থেকে রেহাই দেওয়া যেত। আর যাঁদের বাসায় গৃহকর্মী আছে, তাঁরা যাতে গৃহকর্মীদের বেতনের সঙ্গে প্রতি মাসে এক প্যাকেট প্যাডও কিনে দেন, সে আহ্বানও জানালেন এই তরুণেরা।