শুধু থিয়েটারের নয়, জীবনেরও নায়ক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে দণ্ড নাটকে মো. রায়হান উদ্দিনের পরিবেশনা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে দণ্ড নাটকে মো. রায়হান উদ্দিনের পরিবেশনা

রাজশাহী নগরের আলুপট্টির মোড়ে অটো (ইজিবাইক) থামিয়ে যাত্রী ডাকছেন এক তরুণ। কয়েক দিন আগেই তাঁকে ঢাকা শিল্পকলা একাডেমি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে একটি নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে। অটোরিকশার চালকের ভূমিকায় তিনি যে অভিনয় করছেন, তা কিন্তু নয়। তাঁর পরিচয় অনেক—তিনি অটো চালক, নাট্যকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

ছাত্রটির নাম দেওয়ান মো. রায়হান উদ্দিন। বাবার নাম দেওয়ান মো. ওয়াসিম উদ্দিন। বাড়ি নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার হাতিমণ্ডলা গ্রামে। রায়হান উচ্চশিক্ষার আশা নিয়ে ২০০৯ সালে রাজশাহীতে আসেন। ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে সংস্কৃত বিষয় নিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় বর্ষের ওঠার পরে তাঁর আর ভালো লাগে না। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। ইতিমধ্যেই যুক্ত হয়েছিলেন থিয়েটারের সঙ্গে। অনুশীলন নাট্যদলের একজন কর্মী তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লেও অনুশীলন ছাড়েননি। অনুশীলনের টানেই আসতেন রাজশাহীতে। ২০১৪ সালে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হন নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। এখন তাঁর অষ্টম সেমিস্টার চলছে।

অনুশীলনের সাম্প্রতিক প্রযোজনা এন্তারনেট-এ ‘টিকটিকি’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। এর আগে এই নাট্যদলে দণ্ড, উত্তরখনা ওরবীন্দ্রনাথের রথের রশি নাটকেও তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে। নাটকগুলো ঢাকায়ও মঞ্চস্থ হয়েছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রথের রশি নিয়ে ভারতে গিয়েছিল অনুশীলন, সঙ্গে ছিলেন রায়হানও। এ ছাড়া কলকাতার বারাসাতে মঞ্চস্থ হয়েছে উত্তরখনা

পড়ালেখা ও নাট্যচর্চার ফাঁকে জীবিকার জন্য অটো চালান তিনি
পড়ালেখা ও নাট্যচর্চার ফাঁকে জীবিকার জন্য অটো চালান তিনি

১৯ জানুয়ারি রাজশাহী নগরের আলুপট্টির মোড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা। অটোতে বসে যাত্রী ডাকছিলেন। সে সময় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। রায়হানের বাবা মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। বাবা যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চলে। কিন্তু পড়াশোনার খরচ জোগাতে গেলেই সংসারে খরচে টান পড়ে। এরই মধ্যে অনেক টাকা ঋণ হয়েছে। কিন্তু রায়হান সংসারের বোঝা হতে চান না। তিনি নিজের দায় নিজেই বহন করতে চান। তিনি বলেন, ‘নাট্যকার ভৌমিকের রচনা ও নির্দেশনায় উত্তরখনা নাটকের একটি চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে একটা সংলাপ মনে খুব দাগ কেটেছিল—গাতা ধর সকলে, পাইত না হাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।’ রায়হান মনে করেন, জীবনে কারও কাছে মাথা নত করা যাবে না। থিয়েটারের শিক্ষা আর বাবার আদর্শ তাঁকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে।

একখণ্ড জমি বর্গা নিয়েছিলেন রায়হান। নিজেই তাতে ফসল চাষ করেন। তাঁর হাতে আসে ৩০ হাজার টাকা। রায়হান ভাবেন, এই টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করা যাবে না। তিনি রাজশাহী শহরে এসে একটি পুরোনো অটো কেনেন। দাম ৮০ হাজার টাকা। নগদ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকা শোধ করার জন্য এক বছর সময় নেন তিনি। অটোর মালিক এই শর্তেই তাঁর কাছে রিকশাটি বিক্রি করেন। তিন মাস ধরে ক্লাসের ফাঁকে তিনি রিকশা চালাচ্ছেন। রায়হান বলেন, এতে প্রতিদিন তাঁর ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত আয় হচ্ছে। আশা করছেন আগামী এক বছরের মধ্যেই ঋণসহ গাড়ির বাকি টাকা শোধ করে ফেলবেন। এরপর নিজের পড়াশোনার খরচের জন্য আর ভাবতে হবে না।

রাজশাহী শহর থেকে তো অটো তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। সত্যিই তুলে দেওয়া হলে কী করবেন? একটুও চিন্তা না করে রায়হান বললেন, ‘আমার বিশ্বাস, হাত দুটো থাকলেই আমি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারব।’ থিয়েটার থেকে একটা জিনিস তিনি শিখেছেন, প্রকৃত মানুষ হওয়ার পথে পেশা কোনো অন্তরায় হতে পারে না। যাওয়ার সময় তিনি বললেন, ‘বরং এই প্রতিবেদন পড়ে কেউ যদি আমাকে কৃপা করে আর্থিক সহযোগিতা দিতে আসেন, তাহলেই আমি অসম্মানিত বোধ করব। আমার কাজকে ছোট করে দেখা হবে। এটা যেন কেউ না করেন।’

তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইলে নাট্যকার মলয় ভৌমিক বলেন, ‘টানা ৩৮ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার করে আসছি। বরাবরই এই কথাগুলোই বলে আসছি, কোনো কাজ ছোট নয়। তারপরেও এত দিন কেউ এ রকম কাজ করার সাহস দেখায়নি। রায়হান সেটা করছে। এটা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। রায়হান শুধু থিয়েটারের নায়ক নয়, জীবনেরও নায়ক।’