নারী ও মেয়েদের অধিকার সুরক্ষায় মিডওয়াইফ

বাংলাদেশে নারীদের পরিস্থিতি ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। গত কয়েক দশকে কর্মশক্তিতে অংশগ্রহণ, অপেক্ষাকৃত মানসম্মত ও কার্যকর যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়েছে। ফলে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। তবে দরিদ্র, প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকার নারীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর বিষয়টি এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক রীতি এবং নারী ও মেয়েদের অধিকারের বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ায় তা সামাজিক ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়ের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এতে করে উল্লেখযোগ্য–সংখ্যক মেয়ের বাল্যবিবাহ হচ্ছে, তারা অল্প বয়সে সন্তান ধারণ করছে, তাদের প্রতি নানা ধরনের সহিংসতা হচ্ছে, সন্তান প্রসবের সময় বা বাধাগ্রস্ত প্রসবের সময় তারা জরুরি ভিত্তিতে কাঙ্ক্ষিত ও মানসম্মত দক্ষ ধাত্রীর সেবা পাচ্ছে না, প্রসূতিরাও যথাযথ সেবা পাচ্ছে না। একইসঙ্গে মেয়েদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার বিষয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন প্রজনন অঙ্গের ক্যানসারের মতো রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে। পরিবার পরিকল্পনা ও শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারেও মেয়েদের রয়েছে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতাসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার কথা সরাসরি উল্লেখ আছে। এসডিজির লক্ষ্য ৩-এ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা ও সব বয়সের সবার কল্যাণে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে আছে নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু কমাতে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার। এসডিজির লক্ষ্য ৫-এ লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সব নারী ও মেয়ের ক্ষমতায়ন করা এবং লক্ষ্য ১০-এ বৈষম্য হ্রাস করতে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।

.
.

এসডিজির এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন পেশাদার মিডওয়াইফ পরিকাঠামো গড়ে তোলা এবং জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থায় তাদের অঙ্গীভূত করা। পেশাদার মিডওয়াইফেরা বিশ্বজুড়ে যৌন ও প্রজনন বিষয়ে অভিজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত। তাঁরা নারী ও মেয়েদের অধিকার রক্ষায়ও সরব। পেশাদার মিডওয়াইফেরা আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সহায়তায় নারীদের সেবা দিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি পেশাদার মিডওয়াইফ পদ সৃষ্টি করেছে। ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারের পর বাংলাদেশে পেশাদার মিডওয়াইফদের কার্যক্রম শুরু হয়। এর ফলে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নারী ও মেয়েদের জীবনে ইতোমধ্যে একটা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ২০০ মিডওয়াইফ নিয়োজিত রয়েছেন। কিছু দুর্গম ও দুর্যোগকবলিত এলাকায় এনজিওগুলোর মাধ্যমে মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
মিডওয়াইফেরা এমনভাবে সেবা দিচ্ছেন, যা বাংলাদেশে প্রজননস্বাস্থ্যসেবায় পরিবর্তনের ধারার সূত্রপাত করেছে। এই সেবার মধ্যে রয়েছে পরিবার পরিকল্পনা, সন্তান জন্ম-পূর্ব ও জন্ম-পরবর্তী সেবা, নবজাতকের সেবা, পুষ্টি পরামর্শ, স্বাভাবিক প্রসবসেবা, মাসিক নিয়মিতকরণ, জরায়ুমুখের ক্যানসার শনাক্ত ও যৌন সহিংসতার চিকিৎসাগত ব্যবস্থাপনা। মিডওয়াইফেরা নারী ও মেয়েদের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁরা নারীদের স্বাস্থ্যবিষয়ক জটিলতা কমাতে ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করেন।
পেশাদার মিডওয়াইফদের মাধ্যমে বাংলাদেশে নারী ও মেয়েদের মানসম্মত প্রজননস্বাস্থ্যসেবার অধিকার পাওয়ার বিষয়টি জোরদার হয়েছে। মিডওয়াইফ কর্তৃক সেবা গ্রহণকারী নারী ও মেয়েরা তথ্য ও মানবিক সেবার মাধ্যমে ক্ষমতায়িত হয়েছেন। মিডওয়াইফদের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান ও সচেতনতা নারী ও মেয়েদের সামগ্রিক প্রজননস্বাস্থ্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

মিডওয়াইফেরা আরও যেসব ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন, তার মধ্যে রয়েছে:
* মূল্যবোধ ও গুরুত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে নারী ও মেয়েদের সম্মান প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
* নারী ও মেয়েদের নিজেদের শরীরের নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা।
* বৈষম্য থেকে মুক্তি ও হালনাগাদ স্বাস্থ্যগত তথ্য পেতে সহায়তা করা।
* নিজেদের স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তে নারী-মেয়েদের সক্রিয় অংশগ্রহণের অধিকার ও মতামত দেওয়ার ক্ষমতা নিশ্চিত করা।
* নারী ও মেয়েদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং কোথায় সন্তান প্রসব করবেন, সেই স্থান নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করা।

গর্ভধারণের সময়টি নারী ও মেয়েদের জন্য বিশেষ উদ্বেগের সময়। গর্ভধারণের জটিলতা বা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন নারীর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে সন্তান ধারণ ও প্রসবসংক্রান্ত জটিলতায় দিনে প্রায় ১৫ জন নারীর মৃত্যু হয়। অথচ এসব মৃত্যু অনেকাংশে পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য।
প্রসবের সময় একজন মিডওয়াইফ উপস্থিত থাকলে তিনি সম্ভাব্য জটিলতাগুলো চিহ্নিত করতে পারেন এবং জটিলতা নিরসনে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কমাতে পারেন মৃত্যুর হার। স্বাস্থ্য অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে মানসম্মত প্রজননস্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য মিডওয়াইফদের পেছনে খরচ সেরা বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত।

.
.

জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মিডওয়াইফদের অবদানের বিষয়ে আরও কিছু তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা যায়। যথা:
* মা-সন্তানের সেবার জন্য পেশাদার মিডওয়াইফ থাকলে দুই-তৃতীয়াংশ মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যু এড়ানো যায়।
* তথ্যপ্রমাণে দেখা গেছে, শিক্ষিত ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কাজ করেন এমন মিডওয়াইফেরা নারী ও নবজাতকের জন্য প্রয়োজনীয় সেবার ৮৭ শতাংশ দিতে পারেন।
* মিডওয়াইফারি শিক্ষায় বিনিয়োগ এবং মিডওয়াইফদের কমিউনিটিভিত্তিক সেবায় নিয়োগের মাধ্যমে বিনিয়োগের ১৬ গুণ ফেরত পাওয়া সম্ভব।
* মিডওয়াইফারি সেবা অর্থ শুধু প্রসবকালীন সহায়তা নয়, এটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবারও অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মিডওয়াইফ পদ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন একটি পথ খুলেছে। বর্তমানে মিডওয়াইফদের জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিওগুলোতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি তাঁদের উদ্যোক্তা হিসেবেও কাজের সুযোগ আছে। সম্মানজনক মিডওয়াইফারি পেশা মেধাবী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ প্রজন্মকে, যারা যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তাদের আকৃষ্ট করবে।
মিডওয়াইফারি পেশার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পেশাটির সম্ভাবনার কথা জানাতে বাংলাদেশ মিডওয়াইফারি সোসাইটিকে সঙ্গে নিয়ে ইউএনএফপিএ মাধ্যমিক স্কুলের মেয়েদের কাছে যাচ্ছে। সুইডেন, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহযোগিতায় যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে মিডওয়াইফদের মাস্টার্স করার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে সরকারি-বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষাগত ও ক্লিনিক্যাল পদের জন্য তাঁদের সক্ষম করে তোলা হচ্ছে।
সহায়ক কর্মপরিবেশ পেলেই কেবল মিডওয়াইফেরা উৎকৃষ্ট সেবা দিতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে পদায়নকৃত মিডওয়াইফদের মানসম্মত সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা, অনুকূল পরিবেশ, দক্ষতার উন্নয়ন এবং সামাজিক সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদান। তবে সাথে সাথে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যেন মিডওয়াইফেরা কর্মক্ষেত্র কোনো ধরনের ৈবষম্য, হয়রানি বা অসম্মানের শিকার না হন। মিডওয়াইফদের ক্ষমতায়ন এবং যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য খাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় তাঁদের যুক্ত করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পরিজ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়। এ ছাড়া নারীর চাহিদার কথাও ভালোভাবে জানা সম্ভব হয়।
সব নারী-শিশু ও মিডওয়াইফের জন্য সহজলভ্য ও কার্যকর মিডওয়াইফারি সেবা পাওয়াকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি-সমর্থন দিতে বিশ্বের সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব মিডওয়াইভস (আইসিএম)। আইসিএম মনে করে, সবচেয়ে জরুরি সময়ে যথাযথ সেবা প্রদানকারী হিসেবে মিডওয়াইফের ওপর নারীর অধিকার রয়েছে। অনুরূপভাবে মিডওয়াইফদের পর্যাপ্ত শিক্ষালাভ, পেশাগত চর্চা প্রতিপালনের অধিকার রয়েছে। এসবের গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এই অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে আরও অনেক কিছু করণীয় আছে। মিডওয়াইফারি পেশার সাফল্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ নারী ও মেয়েদের অধিকারের প্রতি তার পরিপূর্ণ অঙ্গীকার প্রদর্শনের সুযোগ নিতে পারে।
ইউএনএফপিএর একটি প্রতিবেদন থেকে অনূদিত

পেশাদার মিডওয়াইফদের ভূমিকা
একজন সনদপ্রাপ্ত পেশাদার মিডওয়াইফ নারীদের স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিশোরী থেকে শুরু করে সব বয়সের নারীর গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের সময় তাঁরা সেবা দেন। নারীদের ক্ষমতায়নেও মিডওয়াইফরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

একজন পেশাদার মিডওয়াইফ কী কী করেন?

  • মেয়ে ও নারীদের পেশাদার ও সম্মানজনক যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন।
  • কিশোর-কিশোরী, নারী-পুরুষ সবাইকে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ করেন, যাতে তাঁরা ওয়াকিবহাল হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
  • যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার দেওয়ার মধ্য দিয়ে পেশাদার মিডওয়াইফরা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা রাখছেন।