দীন থেকে সুদিনে, ওঁরা আজ বিসিএস ক্যাডার

বাবা আইসক্রিম বিক্রি করেন। দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছিল সাইফুলের। আবদুর রহিম নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতে কখনো বাদাম, কখনো ছোলা বিক্রি করতেন। মুদি দোকানে বসেই লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন আলাউদ্দিন খোকন। বিসিএস পরীক্ষার আগের দিনও ভ্যানে করে বাড়ি বাড়ি মুরগি বিক্রি করেছেন আবদুল মজিদ। কষ্টের গল্পগুলো ভিন্ন হলেও চারজনের সফলতার গল্প একই। ৩৫তম বিসিএসে চারজনই আজ ক্যাডার। চারটি সরকারি কলেজে তাঁরা যোগ দিয়েছেন শিক্ষক হিসেবে।

সাইফুল
সাইফুল

পড়ালেখাই বন্ধ হতো বসেছিল সাইফুলের: নাটোরের ছেলে সাইফুলের বাবা দিনমজুর। দারিদ্র্যের কারণে স্কুলেই সাইফুলের লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছিল। নিজে কায়িক পরিশ্রম করে লেখাপড়া শেষ করা সাইফুল আজ বিসিএস ক্যাডার। ৩৫তম বিসিএসের মাধ্যমে সাইফুল এখন নাটোরের একটি সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক।

নিজের কষ্টের জীবনের স্মৃতিচারণা করে সাইফুল বলেন, ‘প্রাইমারি পাস করে যখন হাইস্কুলে ভর্তি হলাম, স্কুল ড্রেস বানাতে পারিনি দেখে তিন মাস স্কুলে যেতে পারিনি। শুধু দেখতাম যে ছেলেরা স্কুলে যায়-আসে আর আমি অপেক্ষায় থাকি কবে আমি ড্রেস পাব আর স্কুলে যাব। বাবা আইসক্রিম বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে ড্রেস বানিয়ে দিলেন। ২০০০ সালে আমি যখন ক্লাস টেনে, তখনই আমার লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছিল। এলাকায় তখন একটা মসজিদ হয়। আমি সেই মসজিদ ঝাড়ু দিতাম। মুয়াজ্জিন না থাকলে আজান দিতাম। মাসিক দেড় শ টাকা বেতন।’
সাইফুল আরও বলেন, ‘এসএসসি পাস করে বাড়ির পাশে একজনের বাসায় কম্পিউটার শিখে তার সঙ্গেই সারা রাত কাজ করতাম। বিকেলে টিউশনি করতাম। এভাবেই উচ্চমাধ্যমিক পাস করে সরকারি একটা কলেজে প্রাণিবিদ্যায় অনার্স পাস করলাম।’
সাইফুল বলেন, ‘সারা বছর কাজ করতাম আর টিউশনি করতাম। পরীক্ষার রুটিন দিলে পড়া শুরু করতাম। তাতেই আল্লাহর রহমতে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স পাস করলাম। ২০১১ সালে ভূমি অফিসে ছোট্ট একটা চাকরি পেলাম। স্বপ্ন দেখতাম জীবনে বড় কিছু করতে হবে। সারা দিন চাকরি করে রাতে পড়তাম। ৩৫তম বিসিএস আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে।’

আবদুল মজিদ
আবদুল মজিদ

মুরগি বিক্রি করেছেন পরীক্ষার আগে: মা-বাবার ছয় সন্তানের মধ্যে একমাত্র আবদুল মজিদই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। শরীয়তপুরে বাড়ি তাঁর। বাবার একটি ছোট্ট মুদি দোকান ছিল। সেই দোকানে বাবাকে সাহায্য করার পাশাপাশি লেখাপড়া করতেন মজিদ। দারিদ্র্যের কারণে বাবা পড়াতে চাইতেন না। কিন্তু মা উৎসাহ দিতেন। সেই ছেলেটি আজ বিসিএস ক্যাডার। শরীয়তপুরের একটি সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
মজিদ বলেন, ‘দারিদ্র্যের কারণে বাবা পড়তে দিতে চাইতেন না। মা উৎসাহ দিতেন। এসএসসিতে ভালো ফল করার পর বাবা আর কিছু বলেননি। উচ্চমাধ্যমিকের পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষ থাকাকালেই দোকানের ঋণ অনেক টাকা হয়ে যাওয়ায় দোকান ছাড়তে হয়। তখন সংসার চালাতে আব্বা বাড়ি বাড়ি মুরগি বিক্রি করতেন। আমি প্রতি শুক্রবার আর যেকোনো বন্ধের দিনে বাড়িতে গিয়ে এই কাজ করতাম। বিসিএস পরীক্ষার আগের দিনও মুরগি বিক্রি করেছি। গ্যারেজ থেকে ভ্যান এনে চালিয়ে যাওয়া, মুরগি ধরা, কাটা—সব করে শরীর ক্লান্ত হয়ে যেত। এগুলো করেই বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছি। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল আমি পারব। আমি পেরেছি।’
বাদাম বিক্রেতা রহিমের গল্প: ঠাকুরগাঁওয়ের দিনমজুর বাবার সন্তান আবদুর রহিমের লেখাপড়া করতে ভালো লাগে। কিন্তু লেখাপড়ার খরচ আসবে কোত্থেকে? প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকাকালেই স্কুলে বাদাম, চানাচুর বিক্রি শুরু করেন। স্কুল শেষে বিকেলে মাটির হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করতেন। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে দারিদ্র্যের কারণে ভর্তি হলেন মাদ্রাসায়। মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে পলেস্টার কাপড়ের একটা পাঞ্জাবি বানিয়ে দুই বছর সেটাই পরেছেন। সেই রহিম ৩৫তম বিসিএস দিয়ে একটা সরকারি কলেজের শিক্ষক।
রহিম সেই জীবনের স্মৃতিচারণা করতে করতে জানালেন, দাখিল পরীক্ষার ফরম পূরণ করেছেন টাকা ধার নিয়ে। ছাত্র পড়িয়ে কিছু টাকা জমিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ফরম তুলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেন। হলে উঠলেন। শুরু হলো নতুন লড়াই।
আবদুর রহিম বলেন, ‘হল–জীবনের এমন দিন খুব কম এসেছে, যেদিন সকালে নাশতা করেছি। প্রথম বর্ষে অধিকাংশ সময় রাতে না খেয়ে থাকতাম। ৭০০ টাকায় একটা টিউশনি পেলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হেঁটে শুক্রাবাদ যেতাম। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন টিউশনি করিয়ে কাটিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে একবার বাড়ি গেছি। এলাকার এক লোক বাবাকে বলে ছেলেকে ঢাকায় পড়ান আর ছেঁড়া টুপি পরে ছেলে নামাজ পড়তে যায়। বাবা সেদিন বাড়িতে এসে অনেক কাঁদেন। আমি কিন্তু হার মানিনি। আর সে কারণেই বোধ হয় আজ আমি বিসিএস ক্যাডার।’

আলাউদ্দিন খোকন
আলাউদ্দিন খোকন

গরু বিক্রি করে পরীক্ষার ফরম পূরণ: ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় আলাউদ্দিন খোকন পরিবারের হাল ধরে মুদি দোকানি হিসেবে। নবম শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরীক্ষার সময় বাবা মারা যান। চাচারা সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠেন। বাড়ির গরু বিক্রি করে পরীক্ষার ফরম পূরণ করেছেন। সেই খোকন ৩৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে প্রাণিবিদ্যায় মেধাতালিকায় দ্বিতীয় হয়েছেন।
জীবনের সেই সংগ্রামের ঘটনাগুলো উল্লেখ করে খোকন বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষা দিলাম বন্ধুর বাড়ি থেকে। উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনার জন্য আরেকজনের বাড়িতে থাকতাম। দিনে সাড়ে আট ঘণ্টা ছাত্রছাত্রী পড়ানোর পর নিজের ঘুমানোর সময় ছিল রাতে আড়াই ঘণ্টা আর দিনে দেড় ঘণ্টা।’
খোকন বলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিকের পর লেখাপড়া আর এগোবে—এমন আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ফরম কেনার টাকা ছিল না। ছাত্র পড়িয়ে টাকা জোগাড় করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেদিন ফরম নিলাম, সেদিনই ছিল ফরম দেওয়ার শেষ দিন। প্রাণিবিদ্যায় ভর্তি হলাম। অনার্সে প্রথম শ্রেণি পেলাম। ঠিক করলাম বিসিএস দেব। আল্লাহর অসীম রহমতে আমি আজ আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। আমি বিশ্বাস করি, সৎ প্রচেষ্টা থাকলে যে –কেউ যেকোনো অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারে।’