সময়ের দুই নায়ক

পারভেজ মিয়ার চোখ–মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। তবে সে ক্লান্তি ছাপিয়ে তখন চোখে পড়ছিল তাঁর ঘুম জড়ানো চোখের পাতা। ভাতঘুমে ছিলেন পারভেজ মিয়া। আমরা এসেছি জেনে তড়িঘড়ি করে উঠেছেন। নিচতলার ব্যারাক থেকে চলে এসেছেন ওপর তলায়। দাউদকান্দি হাইওয়ে থানা ভবনের দোতলায় আমরা যেখানে বসেছি, এটি ডিউটি অফিসারের ঘর। পাশের ঘরটায় বসেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)।
তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করি! কিন্তু কথা তো এগোয় না, আটকে থাকে ওই এক জায়গায়। সে জায়গাটি গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড। এই বাসস্ট্যান্ডের পাশের ডোবায় দুর্ঘটনায় পড়েছিল মতলব এক্সপ্রেস নামের একটি যাত্রীবাহী বাস। সবার চোখের সামনে ধীরে ধীরে ডুবছিল বাসটি। মানুষের বাঁচার আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছিল গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডের বাতাস। পারভেজ মিয়া নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ময়লা দুর্গন্ধময় ডোবায়। অসামান্য দক্ষতায় বাঁচিয়েছিলেন প্রায় ৪০ জনের প্রাণ। ৭ জুলাই এভাবেই ত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন পারভেজ মিয়া। তিনি হাইওয়ে পুলিশের একজন কনস্টেবল।
কয়েক দিন ধরে প্রতিনিয়ত যে কথাগুলো তিনি বলেছেন, আমরাও সে ঘটনাই শুনছিলাম। সেদিনের কথা শোনাতে শোনাতে তিনি বললেন, সেদিন তাঁরই মতো উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আরেকজন। উদ্ধারকাজ শেষে তাঁকে আর খুঁজে পাননি পারভেজ মিয়া। তাঁর কথা শুনে আমরা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। কে সেই মানুষ? তাঁকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায়? এমন অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ১০ জুলাই পারভেজ মিয়ার সঙ্গে আলাপচারিতার সময়ই উদ্ধারকাজে এগিয়ে আসা অপর নায়ক আবদুস সাত্তারের খোঁজ পাওয়া যায়।
তার আগে কথা চলতে থাকে পারভেজ মিয়ার সঙ্গে।

ডোবা থেকে তোলা হচ্ছে দুর্ঘটনায় পড়া বাসটি। ছবি: সংগৃহীত
ডোবা থেকে তোলা হচ্ছে দুর্ঘটনায় পড়া বাসটি। ছবি: সংগৃহীত

গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এই বাসস্ট্যান্ড পড়েছে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায়। চার লেনের সড়কটি দুই ভাগ করেছে একটি ডোবা এবং ফল–সবজির দোকান ও মাছের আড়ত।
ডোবাটি আপাতদৃষ্টিতে দেখলে ময়লার ভাগাড় বলে মনে হয়। তবে গভীর। সেখানে মরা–পচা মাছ, মুরগি থেকে বাজারের প্রতিদিনের আবর্জনা ফেলা হয়। দুর্গন্ধের জন্য সচেতনভাবে কেউ এই ডোবার পাশ দিয়ে হাঁটেন না।
৭ জুলাই সকাল থেকে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন পারভেজ মিয়া। ১১টার দিকে খবর আসে, ভিআইপি বহনকারী গাড়ি যাবে, এই পথ ফাঁকা রাখতে হবে। সে কাজটিই করছিলেন পারভেজ মিয়া। অযথা দাঁড়িয়ে থাকা বাহন সরিয়ে দিচ্ছিলেন। সরাতে সরাতে চলে যান বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা সামনে। একসময় দাঁড়িয়ে পড়েন মাঝের সড়কদ্বীপে। এরই মধ্যে আচমকা শব্দ কানে আসে পারভেজ মিয়ার। বাসস্ট্যান্ডে এমন শব্দ তো কতই শোনা যায়। কিছুই ঠাওর করতে পারেননি। পারভেজ মিয়া বলে যান, ‘হঠাৎ একজন এসে আমাকে বলেন, একটা বাস ডোবায় পড়েছে। ভেতরে অনেক মানুষ আছে।’

নেমে পড়লেন উদ্ধারে
বার্তাবাহকের কথা শেষ না হতেই পারভেজ ছুটে যান ডোবার দিকে। শত শত মানুষ চারপাশে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু কেউ উদ্ধার করতে যাচ্ছেন না। মানুষ বাঁচার জন্য আহাজারি করছে বাসের ভেতর। জানালার ঘোলা কাচে নারী-শিশুদের হাত দেখা যাচ্ছে। দিগ্বিদিক না তাকিয়ে ডোবায় নেমে পড়েন পারভেজ। বলেন, ‘প্রথমে দরজার কাচ ভাঙলাম। হাতের কাছে ডাব, ইট যা ছিল সেটা দিয়েই জানালার কাচ ভাঙছিলাম। অনেক মানুষ এ পথে বেরিয়েছে।’
এরই মধ্যে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন একজন।
এভাবে একে একে প্রায় ২৬ জন নারী, শিশু, বৃদ্ধ মানুষ উদ্ধার করলেন তাঁরা। আরও কেউ কি ভেতরে আছে? বাসের ভেতরে নেমে ডুব দেন। ছোট একটা শরীর টের পান পারভেজ, ‘পাঁচ-ছয় বছর বয়সী এক বাচ্চা ছিল সে। অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল। সে বেঁচে যায়।’
এরই মধ্যে হাইওয়ে পুলিশের উদ্ধারকারী ক্রেন চলে আসে, ছুটে আসেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। শুরু হয় বাস ওঠানোর তোড়জোড়। পারভেজ বলে যান, ‘উঠে আসার পর একজন এসে আমার মানিব্যাগটা হাতে দিলেন, আরেকজন দিলেন আইডি কার্ড আর মুঠোফোনটা। ডোবায় নামার সময় কার হাতে দিয়েছিলাম জানতাম না।’

পেছনের মতলব এক্সপ্রেস বাসের যাত্রীদেরই সেদিন উদ্ধার করেছিলেন পারভেজ মিয়া ও  আবদুস সাত্তার। ছবি: প্রথম আলো
পেছনের মতলব এক্সপ্রেস বাসের যাত্রীদেরই সেদিন উদ্ধার করেছিলেন পারভেজ মিয়া ও আবদুস সাত্তার। ছবি: প্রথম আলো

খোঁজ মিলল সাত্তারের
পারভেজ মিয়ার কথা শুনতে শুনতেই আমরা পেয়ে গেলাম সেই ‘অচেনা’ উদ্ধারকারীর খোঁজ। পারভেজের মতো যিনি ছুটে এসেছিলেন উদ্ধারে। কিছুদিন ধরেই নাকি গৌরীপুরের স্থানীয় কয়েকজন তরুণের ফেসবুকে সেই মানুষের ছবি ভাসছিল। তাঁদের কেউ কেউ লিখেছেন, পারভেজ মিয়ার সঙ্গে আরও একজন উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন। অনেকে ভিডিও থেকে ছবিও নিয়েছেন। পারভেজ সে কথা নিজেই বলেছেন।
অবশেষে সেই মানুষের নাম ও পরিচয় জানা গেল। তিনি আবদুস সাত্তার। কুমিল্লার ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিভাগের চেয়ারম্যান। তাঁর সঙ্গে কথাও হলো পারভেজের। আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি জানালেন, ‘বিকেলে দেখা হচ্ছে’।
আবদুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা হবে বিকেলে। এই ফাঁকে আমরা পারভেজ মিয়ার গ্রামের বাড়ির পথ ধরলাম।

গন্তব্য হোসেনদী
বাজারের নাম জামালদী। দাউদকান্দি থেকে বাসে উঠে মেঘনা ব্রিজের ঠিক গোড়ায় এসে জামালদী নেমেছিলাম। তারপর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চেপে চললাম হোসেনদী। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার এই হোসেনদী গ্রামেই জন্ম পারভেজ মিয়ার।
পিচঢালা সরু পথে খানিকটা যেতেই পারভেজ মিয়া একটা ভবন দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে আমার স্কুল।’ স্কুলের নাম হোসেনদী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়। ২০০৮ সালে এখান থেকে তিনি এসএসসি (কারিগরি) পাস করেছেন। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরই বদলে যায় তাঁর জীবনের গল্প। বড় দুই বোনের বিয়ের আয়োজন, ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ মুক্তিযোদ্ধা বাবা আবুল কাশেমের পক্ষে সামলানো কঠিন ছিল। তখন পরিবারের হাল ধরেন পারভেজ। পরিচিত একজনের সহায়তায় চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে চাকরি নেন। তবে পড়াশোনা থামাননি। ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে ইচ্ছা ও স্বপ্ন পূরণ হয়নি পারভেজের, অকৃতকার্য হন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়। চাকরি ছেড়ে ধারদেনা করে একসময় পাড়ি জমিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। সেখানেও স্বপ্নভঙ্গ। ফিরে আসেন দেশে। ঋণের টাকা শোধ করতে বেছে নিতে হয়েছিল নানা পেশা। এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় পেয়ে যান পুলিশে নিয়োগ। প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে হাইওয়ে পুলিশে যোগদান করেন পারভেজ।
মিনিট পনেরো পর সিএনজিচালিত অটোরিকশা থামল একটা সেতুর ওপর। বেশ দীর্ঘ সেতু। ওপারে গ্রাম। চারপাশে মেঘনা নদী। পারভেজ মিয়া হাতের ইশারায় দেখালেন দূরে একটা চর। নদীর বুকে কচুরিপানার মতো ভাসছে। এই চরটা নাকি একসময় মস্ত বড় গ্রাম ছিল। এখানেই বাড়ি ছিল পারভেজদের। সে সময় তাঁদের অনেক জমি ছিল, স্বপ্ন দেখার মতো শক্তি ছিল। কিন্তু সবকিছু এখন মেঘনার পেটে। পারভেজ এই গল্প শুনেছেন তাঁর বাবা-মায়ের কাছে।
জীবনকাহিনি শুনতে শুনতে আমরা এসে পড়ি পারভেজ মিয়ার বাড়িতে। ছোট দোচালা একটা টিনের ঘর। এ ঘরেই তাঁদের বসবাস। পারভেজ মিয়া বলেন, ‘ঘরটা আমাদের, কিন্তু জমিটা আমার খালাতো ভাইয়ের।’
মুহূর্তে নায়ক বনে যাওয়া পারভেজ সেদিনও বাসায় ফিরেছিলেন। টেলিভিশনে পারভেজের সাহসিকতার খবর আগেই জেনেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তাঁর বোন মায়ামণি বলেন, ‘ওর কাজ দেখে আমরাও গর্বিত। কিন্তু তখন শুধু মনে হয়েছে, পারভেজের কিছু হলে আমাদের কী হতো। পারভেজের আয়েই আমাদের সংসার চলে।’
পারভেজের বাড়িতে থাকতেই ফোন আসে আবদুস সাত্তারের। কুমিল্লা থেকে তিনি চলে এসেছেন গৌরীপুরে। আমরা দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম।

মা–বাবার সঙ্গে পারভেজ মিয়া
মা–বাবার সঙ্গে পারভেজ মিয়া

দেখা হলো দুজনের
হাইওয়ে থানার পাশেই মতলব এক্সপ্রেসের বাসটি রাখা। দুর্ঘটনায় ভাঙাচোরা। সেখানেই দেখা হলো আবদুস সাত্তার ও পারভেজ মিয়ার। আমরা তখন অনেকটা দর্শকের ভূমিকায়। করমর্দন করলেন দুজন। যেন তাঁরা কত দিনের চেনা। তাঁদের কথায় বারবার ফিরে আসছিল উদ্ধার মুহূর্তের নানা ঘটনা। পারভেজ যখন বলছেন, ‘ভাই, আমি আপনাকে পরে অনেক খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি’। সাত্তার বলে চলেন, ‘আমি তো উদ্ধারকারী ক্রেন চলে আসার পরই চলে যাই। আমার স্ত্রী-সন্তান কাউন্টারে বসা ছিল।’
তাঁদের দুজনের কথার তল খুঁজে পেতে আমরা কান পাতি আবদুস সাত্তারের কথায়। তিনি বর্ণনা করলেন উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়ার মুহূর্তটা।

যেভাবে ছুটে গিয়েছিলেন সাত্তার
আবদুস সাত্তারের বাড়ি দাউদকান্দির আঙ্গাউড়া গ্রামে। ঘটনার দিন পরিবারকে ঢাকার বাসে তুলে দিতে এসেছিলেন গৌরীপুর। রাস্তার ওপারে তাঁর স্ত্রী তখন আঠারো মাসের ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। আবদুস সাত্তার ফুটওভারব্রিজে রাস্তা পার হচ্ছেন। আচমকা ডানে দেখলেন, একটা বাস কাত হয়ে পড়ে গেল ডোবায়। বুদ্বুদ করছে, পচা পানি বাসের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে বাস। তিনি দেখতে পাচ্ছেন বাঁচার জন্য মানুষের আকুতি। কোনো দিকে না তাকিয়ে ছুটে গেলেন উদ্ধার করতে। সাত্তার বলতে থাকেন, ‘ঘটনাটা ৭ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে হয়েছে। বাস থেকে আমরা একজন একজন করে মানুষ বের করছিলাম, ডোবার পাশেই তিন-চারজন আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসেন। তাঁরা যাত্রীদের ধরে ওপরে তোলেন।’ উদ্ধারের শেষ দিকে সাত্তারের মাথায় আসে অপেক্ষায় থাকা স্ত্রী-সন্তানের কথা। ততক্ষণে তিনি খেয়াল করেন, তাঁর স্মার্টফোন বিকল হয়ে গেছে। তিনি দ্রুত চলে যান সেখান থেকে।
পাশে দাঁড়ানো পারভেজেরও চোখে যেন সে ঘটনাগুলো খেলে যাচ্ছিল। দুজনের চোখই আর্দ্র হয়ে ওঠে। সেদিন ওপরে উঠে আসতেই পারভেজকে সবাই ঘিরে ধরেন। অনেকে ছবি তোলেন। কিন্তু পারভেজ বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি ধাতস্থ হতে পারেন না, কী করলেন এটা। কীভাবেই বা করলেন। পারভেজ মিয়া বলেন, ‘মানুষ আমাকে বাহবা দিবে, পুরস্কৃত করবে—এসব কিছুই মাথায় আসেনি। শুধু ভেবেছি—মানুষ মারা যাচ্ছে, তাদের বাঁচাতে হবে।’