মানবতার প্রতি তোমার অবদান 'লাইক' দিয়ে বিচার কোরো না

>অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক। গত ৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।
টিম কুক
টিম কুক

হ্যালো এমআইটি! ধন্যবাদ। অভিনন্দন ২০১৭ সালের স্নাতক। আজ এখানে আসতে পেরে আমি সত্যি খুব খুশি। আজকের দিনটা উদ্‌যাপনের। গৌরবের। জীবনের নতুন একটা যাত্রা তোমরা শুরু করতে যাচ্ছ। এই যাত্রায় কিছু প্রশ্ন তোমার মাথায় আসবে—আমি কোথায় যাচ্ছি? আমার গন্তব্য কোথায়? হ্যাঁ, এই প্রশ্নের মুখোমুখি আমিও হয়েছিলাম এবং উত্তরটা খুঁজে পেতে প্রায় ১৫ বছর সময় লেগে গেছে। আজ আমার অভিজ্ঞতা তোমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে হয়তো আমি তোমাদের খানিকটা সময় বাঁচাতে পারব।

 ‘বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?’ হাইস্কুলে পড়ার সময় ভাবতাম, এই ‘বহুল প্রচলিত’ প্রশ্নের উত্তর পেলেই বুঝি জীবনের লক্ষ্যটা আমার জানা হয়ে যাবে। হলো না। কলেজে উঠে ভাবলাম, ‘তুমি কোন বিষয়ের ওপর মেজর করছ?’ এই প্রশ্নের উত্তরেই হয়তো জীবনের লক্ষ্য লুকিয়ে আছে। তা-ও হলো না। অবশেষে ভাবলাম, একটা ভালো চাকরি পেলে হয়তো গন্তব্য খুঁজে পাব। কয়েক দিন পর মনে হলো, লক্ষ্য খুঁজে পেতে হলে বোধ হয় চাকরিতে কিছুটা পদোন্নতি পেতে হয় । এই ভাবনাও ভুল প্রমাণিত হলো।

আমি নিজেকে বারবার বোঝাচ্ছিলাম, এই তো সামনেই, আর কদিন পরই লক্ষ্যটা খুঁজে পাওয়া যাবে। সে আশার গুড়ে বালি। এবং এই গন্তব্যহীনতা সত্যিই আমাকে খুব ভোগাচ্ছিল। আমার একটা অংশ আমাকে নতুন একেকটা অর্জনের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। একই সঙ্গে আরেকটা অংশ প্রশ্ন করছিল, ‘এসব অর্জন করে কী হবে?’ উত্তরের খোঁজে আমি ডিউক স্কুলে গিয়েছি। যোগ ব্যায়াম করেছি। বিখ্যাত দার্শনিক, লেখকদের লেখা পড়েছি।

জীবনের নানা মোড় ঘুরে, এই নিরন্তর অনুসন্ধান অবশেষে আমাকে অ্যাপলে নিয়ে এল। সেটা প্রায় ২০ বছর আগের কথা। সে সময় প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকার জন্য লড়াই করছিল। স্টিভ জবস তখন মাত্রই অ্যাপলে ফিরে এসেছেন এবং ‘থিংক ডিফারেন্ট’ প্রচারণা শুরু করেছেন। সেরা কাজটা বের করে আনতে তিনি তখন খ্যাপাটে, বিদ্রোহী, ঝামেলাদায়ক কর্মীদেরই বেশি করে সুযোগ দিচ্ছিলেন। স্টিভ জানতেন, এরাই একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারবে।

তাঁর মতো এত অসাধারণ নেতার সঙ্গে আমার আগে দেখা হয়নি। স্পষ্ট লক্ষ্য আছে, এমন প্রতিষ্ঠানে আমি আগে কাজ করিনি। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য সহজ—মানবতার সেবা। দীর্ঘ ১৫ বছর অনুসন্ধানের পর হঠাৎ অ্যাপলে এসে মনে হলো, আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়েছি। অবশেষে একটু থিতু হলাম। থিতু হলাম এমন একটা প্রতিষ্ঠানে, যেখানে চ্যালেঞ্জ আছে, যার লক্ষ্য অনেক বড়। এমন একজন নেতার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হলো, যিনি বিশ্বাস করেন, নতুন কোনো প্রযুক্তিই পারে আগামী দিনের পৃথিবীটাকে বদলে দিতে। আমি নিজের ভেতরে নিজেও থিতু হলাম, খুব গভীরে অনুভব করলাম, আমি এখন অনেক বড় একটা কিছুর অংশ।

প্রতিষ্ঠানের একটা লক্ষ্য আছে বলেই আমি নিজের লক্ষ্যটা খুঁজে পেয়েছিলাম। স্টিভ এবং অ্যাপল আমাকে আমার পুরোটা উজাড় করে দিতে সাহায্য করেছে, প্রতিষ্ঠানের মিশনকে আমি নিজের মিশন ভাবতে পেরেছি। কীভাবে আমি মানবতার সেবা করতে পারি? এটা জীবনের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমি মনে করি, এই প্রশ্নই তোমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে? কীভাবে তুমি মানবতার সেবা করতে চাও?

সুখবর হলো, তোমরা সঠিক পথেই আছ। প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু করা যায়, এমআইটিতে তোমরা সেটা শিখেছ। ক্যানসার থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা শিক্ষার বৈষম্য, সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে প্রযুক্তি। আবার কখনো কখনো এই প্রযুক্তিই সমস্যার অংশ।

প্রযুক্তি আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বেশির ভাগ সময় এটা আমাদের ভালোর জন্য ব্যবহার হচ্ছে, আবার গোপনে ক্ষতিকর দিকটাও ছড়িয়ে পড়ছে। নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা, মিথ্যা সংবাদ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অসামাজিক করে তোলা—সবকিছু নিয়েই কথা হচ্ছে। যে প্রযুক্তির আমাদের একে অপরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কথা, সেই প্রযুক্তিই আমাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অসাধারণ সব পরিবর্তন আনা যায়। তবে এই পরিবর্তন আনার ক্ষমতা প্রযুক্তির হাতে নেই, আছে আমাদের হাতে। এই দায়িত্ব আমাদের, পরিবারের, প্রতিবেশীর, সমাজের। সৌন্দর্যের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস, উদারতা, শালীনতাবোধ—এ সবই আমাদের পথ দেখাবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কম্পিউটারকে মানুষের মতো ভাবার সক্ষমতা দিচ্ছে, এ নিয়ে আমি চিন্তিত নই। আমি বরং চিন্তিত এই নিয়ে যে মানুষ কম্পিউটারের মতো ভাবতে শুরু করেছে। যে ভাবনায় মূল্যবোধ নেই, সমবেদনা নেই। এসব ক্ষেত্রেই তোমাদের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন। কারণ, বিজ্ঞান যদি অন্ধকারে একটা অনুসন্ধান হয়, তাহলে মানবতা হলো সেই মোমবাতি, যা আমাদের দেখাবে আমরা কোথায় আছি, সামনে কোনো বিপদ আছে কি না।

স্টিভ একবার বলেছিলেন, শুধু প্রযুক্তিই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন প্রযুক্তির সঙ্গে শিল্প ও মানবতার মিলন। সবকিছুর কেন্দ্রে যখন ‘মানুষ’ থাকবে, তখনই তুমি দারুণ একটা ফল পাবে। যেমন আইফোন, যা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষকে ম্যারাথনে দৌড়াতে সাহায্য করে। যেমন অ্যাপল ওয়াচ, যা হার্ট অ্যাটাক রোধ করতে হৃৎস্পন্দনের খবর দেয়। যেমন আইপ্যাড, যা বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের একটা অন্য জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। অর্থাৎ এমন এক প্রযুক্তি, যা মানুষের মূল্যবোধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে।

তোমাদের ব্যাপারে আমি আশাবাদী, কারণ তোমাদের প্রজন্মের ওপর আমার আস্থা আছে। আমরা সবাই তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছি। বাইরের পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু আছে, যা তোমার মনকে ঘৃণায় ভরে দেবে। ইন্টারনেট মানুষের হাতে যেমন ক্ষমতা তুলে দিয়েছে, তেমনি ইন্টারনেটই কেড়ে নিতে পারে তোমার শালীনতা ও সৌন্দর্যবোধ। এই অন্ধকারে হারিয়ে যেয়ো না। জীবনটাকে এত তুচ্ছ করে দেখো না। ‘ট্রল’ এ ডুবে থেকো না, এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো এমন কিছু কোরো না যেন তুমিই একটা ট্রলের অংশ হয়ে যাও। মানবতার প্রতি তোমার অবদান ‘লাইক’ দিয়ে বিচার কোরো না, বরং দেখো কতগুলো জীবনে তোমার ছোঁয়া আছে।

লোকে কী ভাববে, এ নিয়ে ভাবা যখন বন্ধ করলাম, তখনই আমার পৃথিবীটা বড় হয়ে গেল। তুমি কী চাও, সেদিকেই মনোনিবেশ করো। মানবতার জন্য তুমি কী করেছ, সেই প্রশ্নের উত্তরও একদিন দিতে হবে। তৈরি হও। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ

সূত্র: কোয়ার্টজ