মোরা আকাশের মতো বাধাহীন...

>
গান গেয়ে বন্যার্ত মানুষের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
গান গেয়ে বন্যার্ত মানুষের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
তরুণেরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, ঝরনার মতো চঞ্চল। দেশের যেকোনো দুর্যোগে নিজেদের জায়গা থেকে, নিজেদের মতো করে তাঁরা প্রাণে প্রাণ মেলাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ বছরও বন্যাকবলিত মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। পড়ুন তাঁদেরই কয়েকজনের অভিজ্ঞতা

মানুষের ভালোবাসা পাওয়া একটা বড় ব্যাপার
মোতাকাব্বির খান
বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে ফেসবুকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ নামে আমাদের একটা গ্রুপ আছে। এই গ্রুপের মাধ্যমে আমরা বন্যার্তদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করেছি। বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা সাহায্য করেছেন। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায়ও আমরা টাকা তুলেছি। প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকার ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলাম দিনাজপুরের তিনটি উপজেলায়। গিয়ে দেখলাম, খাবার কিংবা বিশুদ্ধ পানির চেয়ে এখন তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করাটাই বেশি জরুরি। আমরা তো সেভাবে নগদ অর্থ এত বেশি নিয়ে যাইনি, তবু যা ছিল হাতে, তা-ই তাদের দিয়ে এসেছি। আরও সাহায্য সংগ্রহ করতে পারলে আমরা আবার যাব।

ত্রাণ দিয়ে ফেরার পথে মনে হচ্ছে, আমি একজন অন্য মানুষ। আগে যেভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতাম, এখন হয়তো একটু অন্যভাবে মিশব। মানুষের মুখে তৃপ্তি দেখার, তাদের ভালোবাসা পাওয়ার মধ্যে যে একটা শান্তি আছে, এটা আমি জেনেছি।

যাতায়াতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস দেওয়া হয়েছে
আসাদুজ্জামান
তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

দিনাজপুরের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমাদের ওপর আলাদা একটা দায়িত্ব ছিল। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগ-অনুষদ-ক্লাব থেকে তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে। আমাদের দলটা প্রথমে গিয়েছে কাহারোল উপজেলায়। সেখানে গিয়ে দেখলাম, বন্যার পানি তত দিনে নেমেছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বেশির ভাগ মানুষের মাটির বাড়ি ছিল। ওগুলো সব নষ্ট হয়েছে। তাদের সাহায্য করার পর আবার আমাদের দুটি দল গেছে কুড়িগ্রাম আর বগুড়ায়। ওসব এলাকায় তখনো বন্যার পানি নামেনি। যে নৌকায় ত্রাণ দেওয়া হচ্ছিল, সেটা তীরে ভেড়ার আগেই দেখা যাচ্ছিল দূর থেকে মানুষ সাঁতরে চলে এসেছে। বগুড়ার দিকে ত্রাণ খুব বেশি পৌঁছায়নি মনে হয়। আমাদের নৌকাটা যখন ফিরছিল, তখন ক্ষুধার্ত মানুষ এমনভাবে নৌকা টেনে ধরছিল যে নৌকাটা প্রায় ডুবতে বসেছিল। খুব মন খারাপ হয়েছিল তখন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও ধন্যবাদ দিতে হয়। যতগুলো দল ত্রাণ দিতে গেছে, তাদের সবার যাতায়াতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস দেওয়া হয়েছে।

যে যার জায়গা থেকে সাহায্য করছে

মো. মইনুলইসলাম
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সেদিন আড্ডা দিতে দিতে বন্যার্তদের জন্য টাকা তোলার আইডিয়া মাথায় এল। নীল ভাই প্রথমে প্রস্তাব দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জনের মতো মানুষ মিলে আমরা টাকা তোলার কাজটা করলাম। পদ্মা গার্ডেন, জিরো পয়েন্ট, রেলওয়ে স্টেশনসহ রাজশাহী শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গিয়ে গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলেছি। সেই ত্রাণ কীভাবে দিতে যাব, সেটা নিয়ে সবাই ভাবছিল। এরপর বাস মালিক সমিতির লোকদের কাছে আমরা যাই বাস ভাড়া করার জন্য। বন্যার্তদের সাহায্য করতে যাব শুনে তাঁরা জানালেন, আমাদের যাতায়াত বাবদ কোনো টাকা তাঁরা নেবেন না। এই যে সবাই যে যার জায়গা থেকে সাহায্য করছে, এটা আমার খুব ভালো লেগেছে।

আমাদের জন্য তাঁরা দোয়া করেছেন

মরিয়ম আদরী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

টাকা তোলার সময় আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। রোটারি ক্লাবের আঙ্কেলরা সবাই এক-দুই হাজার টাকা করে দিয়েছেন। তবে কষ্ট হয়েছিল ত্রাণ দিতে যাওয়ার সময়। ঢাকা-কুড়িগ্রাম হাইওয়ে ভেঙে গেছে। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ছিল। আমরা পরে ধরলা ব্রিজে গিয়ে দেখি কয়েকটা সাইন বোর্ডে লেখা—‘সরকারি নৌকা। যাত্রীদের বিনা ভাড়ায় যাতায়াতের জন্য।’ এরপর সেখান থেকে নৌকা নিয়ে আমরা আবার এগিয়ে যেতে থাকি। বাকি দুই ঘণ্টার রাস্তা যেতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লেগেছে। একটা ব্যাপার দেখে খুব মন খারাপ হলো। মানুষগুলো রাস্তায় তাঁবু টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অথচ নিজেদের চেয়ে বেশি যত্ন করে তারা গবাদিপশুগুলোকে আগলে রেখেছে। এই বন্যায় সব হারিয়ে ওগুলোই তাদের শেষ সম্বল। এই বন্যার মধ্যেই আবার অনেকে মা হচ্ছেন। নবজাতককে নিয়ে মায়ের অমন কষ্ট দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল। এই মানুষগুলো আমাদের সামান্য সাহায্য পেয়ে এত খুশি হয়েছিল যে সেদিন মসজিদে আমাদের জন্য বিশেষ দোয়াও করেছে তাঁরা।

আমাদের দায়িত্বটা অনেক বড়

সালমান মাহী রুহুল কাওসার
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ

দিনাজপুরে যেহেতু বন্যা হয়েছে, আমাদের দায়িত্বটা অনেক বড় ছিল। সারা দেশের মেডিকেল কলেজগুলোই সাধ্যমতো বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছি। আমাদের মেডিকেল কলেজ থেকে শিক্ষার্থী আর ইনটার্ন চিকিৎসকদের নিয়ে একটা দল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এই দল বন্যাকবলিত জায়গাগুলোয় গিয়ে কাজ করছে।

আবার ঢাকা বা অন্যান্য এলাকা থেকে বন্ধুরা দল বেঁধে ত্রাণ নিয়ে আসছে। ওরা আমাদের সঙ্গে থাকছে। বন্যাকবলিত যেসব এলাকা ওরা চেনে না, আমরা ওদের সেখানে নিয়ে গিয়েছি। একটু ভয়ে ছিলাম যে বন্যার সময় পানিবাহিত রোগগুলো হয়তো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। ভাগ্য ভালো, তেমন কিছু হয়নি। বন্যার কারণে অনেকের চর্মরোগ হচ্ছে, আমরা তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করছি। এ ছাড়া এই সময়টাতেই বোধ হয় মেডিকেল লাইফের সবচেয়ে বেশি সাপে কাটা রোগী দেখলাম। তাদেরও আমরা সেবা দিচ্ছি।

অতিথিপরায়ণতা দেখে অবাক হয়েছি
হান্না বিনতে আলী
দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বন্যার্তদের সাহায্য করার কথা আমাদের বিভাগের শিক্ষক সিক্তা ম্যাম প্রথম বলেছিলেন। তাঁর কথা শুনে আমরা দেরি না করে কাজে নেমে যাই। আমাদের হাতে সময় খুব কম ছিল বলে চিন্তা হচ্ছিল টাকা তুলতে পারব কি না। বিভাগের সবার কাছ থেকে টাকা তুলেছি। ম্যাম নিজেই শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা তুলে আমাদের হাতে দিয়েছেন। শুক্রবার ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে অনেকে ঘুরতে আসে বলে সেদিন ক্যাম্পাসে কাজ করেছি। এ ছাড়া স্মৃতিসৌধ-ধানমন্ডি লেকে গিয়ে টাকা তুলেছি। অবাক হয়েছি যখন রিকশাওয়ালা-সিএনজিওয়ালা মামারা ডেকে ডেকে তাঁদের সাধ্যমতো সাহায্য করছিলেন। আরও অবাক হয়েছি ত্রাণ দিতে গিয়ে। আমরা কুড়িগ্রামে যে ভাইয়ের বাসায় উঠেছি, তার বাসার আশপাশের অনেকে আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর দুজন ডাক্তার বন্ধু নিজ আগ্রহে আমাদের সঙ্গে থেকে রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়েছেন। আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছি এই এলাকার মানুষের অতিথিপরায়ণতা দেখে। আমরা যখন বিভিন্ন চরে গিয়ে ত্রাণ দিচ্ছিলাম, তখন প্রায় সবাই তাদের বাসায় যেতে বলছিল। এই বন্যার মধ্যে তারা কী দিয়ে আপ্যায়ন করত, তা আমার জানা নেই। কিন্তু সামান্য ত্রাণ পেয়ে তাদের মুখের হাসি আর এই আতিথেয়তা আমাকে অভিভূত করেছে।

আরও কিছু করতে পারলে ভালো লাগত

আবীর বসাক
ওয়েট প্রসেসিং বিভাগ, বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, টাঙ্গাইল

সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা বন্যার্তদের সাহায্য করার কথা ভাবি। আমাদের কয়েকজন বন্ধুর বাসা আছে চরাঞ্চলের আশপাশে। বন্যায় সেখানকার মানুষের দুর্বিসহ জীবন দেখে আমরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিই তাদের জন্য কিছু করব। আমাদের ক্যাম্পাসের চারটি বর্ষের শিক্ষার্থী ও স্যারদের কাছ থেকে সম্মিলিতভাবে প্রায় ১৮ হাজার টাকা জোগাড় করেছিলাম। সামান্য কিছু অর্থ এসেছিল ক্যাম্পাসের বাইরের এলাকার কয়েকজনের মাধ্যমে। তা দিয়েই বন্যার্তদের জন্য একবেলার খিচুড়ি, চিড়া, মুড়ি, গুড়, স্যালাইন, পানিশোধন ট্যাবলেট, বিশুদ্ধ পানি আর ওষুধ নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের গন্তব্য ছিল ভূঞাপুর উপজেলার গাবসাড়া ইউনিয়নের চরাঞ্চল। সেখানকার বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক পরিবারকে আমরা ত্রাণ দিই। আসলে এত বেশি মানুষ ভিড় করেছিল যে সবাইকে ঠিকমতো দিতে পারিনি। আমাদের বাজেট কম ছিল। এ কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে না গিয়ে টাঙ্গাইল জেলায়ই ত্রাণ বিতরণ করেছি। যতটুকু পেরেছি তা দিয়েই সাধ্যমতো সাহায্য করেছি। তাদের জন্য আরও কিছু করতে পারলে ভালো লাগত।

গ্রন্থনা: সাহিব নিহাল