সময় এখন শমীর

নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের বিশাল মাঠটাতে তখন জড়ো হয়েছে প্রায় ষাট হাজার দর্শক। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে হাজির বলিউডের তারকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। তুমুল করতালির মধে্য তিনি মঞ্চে ডেকে নিলেন এক তরুণীকে। বললেন, ‘শমী হাসান চৌধুরীকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। শমী বাংলাদেশের একজন স্বাস্থ্যকর্মী। পাশাপাশি সে অ্যাওয়ারনেস থ্রিসিক্সটি নামের একটি সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা। চলুন, আমরা এই অসাধারণ নারীকে স্বাগত জানাই।’ চিৎকার মিশ্রিত করতালি দিয়ে প্রিয়াঙ্কার কথায় সাড়া দিল দর্শক। এক হাতে বাংলাদেশের পতাকা আর অন্য হাতে মাইক্রোফোন ধরে বক্তব্য দিলেন শমী।

‘কেমন লাগছিল?’ ঘটনার দুই দিন পর মেসেঞ্জারে জানতে চাই তাঁর কাছে। ওপাশ থেকে উত্তর আসে, ‘এর আগেও আমি বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছি। কিন্তু এত বিশাল সংখ্যক দর্শকের সামনে কখনো কথা বলিনি। জীবনের সেরা মুহূর্ত বললেও ভুল হবে না। যদিও মঞ্চ থেকে নেমেই আমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। এত মানুষের সামনে আমি বক্তব্য দিলাম, দৃশ্যটা মা যদি দেখতে পেতেন!’

হিউ জ্যাকম্যানের সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা হাতে
হিউ জ্যাকম্যানের সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা হাতে

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শমীর মা আশরাফুন নেসা মারা গিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। এর আগে থেকেই বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শমী। মায়ের মৃত্যুর পর পুরোদমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। বলছিলেন, ‘২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল। সেদিন ছিল পয়লা বৈশাখ। মাত্র এক দিনের ডায়রিয়ায় আমার মা মারা গিয়েছিলেন। ডায়রিয়া যে এত ভয়ংকর হতে পারে, এর আগে আমি জানতাম না।’

মায়ের মৃত্যুর শোক শমীর জন্য শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। বিভিন্ন প্রকল্পের অংশ হয়ে কখনো তিনি ছুটে গেছেন ময়মনসিংহের পতিতাপল্লিতে, কখনো-বা হরিজনপল্লিতে গিয়ে কথা বলেছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে। লক্ষ্য একটাই, পানিবাহিত রোগের কারণে আর কেউ যেন প্রিয়জনকে না হারায়। নিরাপদ পানি, সুস্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তিনি কাজ করছেন ছয় বছর ধরে। সমাজসেবায় অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ এরই মধ্যে বহু অর্জন জমা হয়েছে তাঁর ঝুলিতে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইয়ুথ এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড স্টাডি’ (ইয়েস) প্রকল্পের আওতায় ২০১১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সে দেশে থেকে স্বেচ্ছাসেবায় নিয়োজিত ছিলেন, বারাক ওবামার কাছ থেকে পেয়েছেন ‘প্রেসিডেনশিয়াল ভলান্টিয়ার সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড (গোল্ড)’। এ বছর তিনি আন্তর্জাতিক সেবামূলক সংস্থা গ্লোবাল সিটিজেনের নিরাপদ পানি, সুস্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক তরুণ মুখপাত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। সে সুবাদেই পেয়েছিলেন ১৭ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত গ্লোবাল সিটিজেন উইক-এর টিকিট।

দর্শকদের সঙ্গে শমীকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন প্রিয়াংকা চোপড়া
দর্শকদের সঙ্গে শমীকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন প্রিয়াংকা চোপড়া

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ছিলেন শমী হাসান চৌধুরী। এ বছরের শুরুর দিকে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে চলে গেছেন ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়ায় (ইউপিএম)। সেখানে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক করছেন তিনি। গ্লোবাল সিটিজেন উইকে অংশ নিয়ে শমী আবার মালয়েশিয়ায় ফিরেছেন। তাই তাঁর সঙ্গে আলাপটা মেসেঞ্জারেই সারতে হলো। নিউইয়র্কে এবার কী কী অভিজ্ঞতা হলো, প্রশ্ন করি শমীর কাছে। ওপাশ থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় শ শব্দের দীর্ঘ উত্তর পাঠিয়ে সব শেষে তিনি লিখলেন, ‘আমার তো আরও অনেক কিছু বলা বাকি!’

সত্যিই বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে ২২ বছর বয়সী এই তরুণীর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল টেডরস অ্যাডহেনম, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা বেশ কয়েকজন সমাজকর্মী, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। সবাই এই ‘ছোট’ মানুষটার বড় কাজগুলোর প্রশংসা করেছেন। গ্রিন ডে, চেইন স্মোকারস, দ্য কিলারস, দ্য লুমিনারসের মতো জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলো যেই মঞ্চে গান গেয়েছে, সেই একই মঞ্চে বক্তব্য দিয়েছেন শমী। গ্রিন রুমে তাঁর দেখা হয়েছে একঝাঁক তারকার সঙ্গে। বাংলাদেশের পতাকা হাতে ঘুরে ঘুরে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। শমী বলছিলেন, ‘হিউ জ্যাকম্যানকে দেখে আমার তো পাগলপ্রায় অবস্থা। পতাকা হাতে তাঁর সঙ্গে ছবি তুলেছি। বললাম, বাংলাদেশে উলভারিনের অনেক ভক্ত আছে। শুনে তিনি খুব খুশি হলেন। অভিনেত্রী ফ্রিদা পিন্টো, গায়িকা ডেমি লোভাটোসহ অনেকেই আমার কাজের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের গায়ক ফেরেল উইলিয়ামসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাঁকে একটা ছোট্ট রিকশা উপহার দিয়েছি। রিকশা হাতে নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে একটা সেলফিও তুলেছেন।’ সেদিন মঞ্চে ফেরেল তাঁর বিখ্যাত ‘হ্যাপি সং’ গেয়েছিলেন। তবে শমীর কথা শুনে বোঝা গেল, তাঁর মনে ‘আনন্দের গান’ বাজছিল সারা দিন ধরেই।

এখন লক্ষ্য কী? বাবা হাসান আহম্মেদ চৌধুরী ও মা আশরাফুন নেসার বড় মেয়ে শমী হাসান চৌধুরী বললেন, ‘আমার সংস্থা, অ্যাওয়ারনেস থ্রিসিক্সটির (facebook.com/awareness360sayyestochange) মাধ্যমে বাংলাদেশের সব বৈধ পতিতাপল্লিতে গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসচেতন করতে চাই। সব কটি হরিজনপল্লিতে যেতে চাই। মোটকথা, নিরাপদ পানি আর সুস্বাস্থ্য নিয়েই কাজ করে যাব।’