সাত সাহসী তৈরির গল্প

ময়মনসিংহের নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাত সাহসী কিশোরী নিজেদের এক সহপাঠীর বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দিয়েছিল এ বছরই। এরপর বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং রুখে দিতে তৈরি করেছে ‘ঘাসফুল’ নামের একটি সংগঠন। প্রথম আলোর ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এই ছাত্রীদের নিয়ে তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র সাত সাহসী। ছুটির দিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে এই তথ্যচিত্র নির্মাণের নেপথ্য গল্প বলেছেন সাত সাহসীর পরিচালকদ্বয়ের একজন রেদওয়ান রনি


গত কয়েক বছরের মতো এবারও নভেম্বর আসার ঠিক আগে আগে অপেক্ষা করছিলাম প্রথম আলো থেকে কখন ডাক আসে তথ্যচিত্র নির্মাণের। অবশ্য, এই অপেক্ষাটা মূলত এ বছরে কোন সাফল্যের গল্পটা আমাকে নির্মাণ করতে বলা হবে সেটির।

নির্মাতা হিসেবে ফিকশন বানানোর পাশাপাশি নন-ফিকশনের মধ্যে তথ্যচিত্র নির্মাণ আমার খুব প্রিয় বিষয়। আর যদি সেটা হয় কোনো সাফল্যের গল্প তাহলে আমি নিজে সেই সাফল্য থেকে পজিটিভ এনার্জি নিয়ে নিই চার্জ হিসেবে, আমার আনন্দ হয়। বিশেষ করে ব্যাপারটা ঘটেছে কলসিন্দুরের অদম্য মেয়েদের ফুটবলের সাফল্যের গল্প বলতে গিয়ে।

প্রতিবছর প্রথম আলো তথ্যচিত্রে নিজেদের গুণগান বাদ দিয়ে বাংলাদেশের আনাচকানাচ থেকে সাফল্যের গল্প খুঁজে বের করে হাতে ধরিয়ে দেয় একদম স্বাধীনভাবে তথ্যচিত্র নির্মাণের, সেটা এক অন্য ভুবনের আনন্দ। বিশদ লিখতে গেলে মূল গল্প থেকে সরে যাব।

এবারও সাজ্জাদ শরিফ ভাই অক্টোবরের শুরুতেই ফোন দিয়ে বলে দিলেন, ‘আনিস (আনিসুল হক) যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পরই বসবে গল্প নিয়ে তোমার সাথে, সময় বের করে রেখো।’

শুটিং পর্ব
শুটিং পর্ব

সময় তো প্রতিবছর বের করেই রাখি। যথারীতি আনিসুল হক ভাই দেশে আসার পর বসলাম একসঙ্গে, এবার কাদের সাফল্যের গল্প বলব আমরা? অনেক গল্প বাছাই, সত্যতা যাচাই শেষে যে কয়টা গল্প শর্ট লিস্টে জায়গা পেল সেগুলো নিয়ে আমরা পপকর্ন টিম অফিসে ফিরলাম।

কিন্তু ঠিক কোনো গল্পকেই যেন জুতসই বাঁধা যাচ্ছিল না মনের সঙ্গে।

প্রথম আলো কার্যালয়ে দ্বিতীয় বৈঠকে আনিস ভাই হঠাৎ বলে উঠলেন ‘ঘাসফুল’-এর কথা।

‘ঘাসফুল’?

পাশেই তৌহিদা শিরোপা যোগ দিলেন আলোচনায়। শিরোপার কাছে জানলাম ময়মনসিংহের নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাত সাহসী কিশোরী নিজেদের এক সহপাঠীর বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছে। এরপর শিশুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং রুখে দেওয়ার একটি সংগঠন তৈরি করেছে ‘ঘাসফুল’ নামে।

সঙ্গে সঙ্গেই শিরোপার কম্পিউটার থেকে প্রিন্টারে কমান্ড গেল প্রথম আলোয় ১৮ এপ্রিল প্রকাশিত সাত সাহসীর গল্পের প্রতিবেদন প্রিন্ট করার।

শুটিংয়েও সাবলীল সাহসী সাত কিশোরী
শুটিংয়েও সাবলীল সাহসী সাত কিশোরী

প্রতিবেদনের প্রিন্ট নিয়ে যাওয়া হলো প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছে। আনিসুল হক তাঁকে বললেন, ‘আমাদের িথম সাহস। এটা মিলে যায়। বাল্যবিবাহ প্রচার আমাদের অঙ্গীকার।’ মতিউর রহমান রাজি হলেন। 

বরাবরই দেখেছি ইতিবাচক কোনো খবরে আনিস ভাইয়ের চোখ শিশুর মতো আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। এতটুকুন বয়সের হাইস্কুলপড়ুয়া কিশোরীরা যে অন্যায়ের প্রতিবাদে এক হয়েছে, এ রকম গল্পই তো বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলে।

হ্যাঁ, এ রকম একটি গল্পের জন্যই সারা বছর অপেক্ষা করি আমি।

শুটিংয়ের প্রস্তুতি

সাত সাহসীর গল্প নির্মাণের লক্ষ্যে পপকর্ন টিম শুরু করল প্রস্তুতি।

শুরুতেই সত্য ঘটনার ভিত্তিতে চিত্রনাট্য লেখার পালা।

প্রথম আলোর নারীমঞ্চে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও নান্দাইল প্রতিনিধি রমেশ চন্দ্রের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে লিখতে বসলাম চিত্রনাট্য, ঠিক ঠিক যেন ফ্রেমে সুন্দর করে বলা যায় কিশোরীদের বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়ার গল্পটা। ঠিক কোন রকমের আলোর ব্যবহার ফুটিয়ে তুলবে তাদের সাহসের কথা, ঠিক কোন ধারা বিবরণীর মাধ্যমে বলা হবে গল্পটা, কতটা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে গেলে বড় বড় মানুষের অন্যায়ের প্রতিবাদকে ঠিকঠাক প্রকাশ করা যাবে, ফ্রেমে ফ্রেমে চলল সে হিসাবনিকাশ। যখন প্রথম খসড়া দাঁড়িয়ে গেল, আনিস ভাইকে পাঠানোর পর বললেন, ‘ঠিক আছে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ো।’

এরপর শুটিং দল গঠনের পালা। পপকর্নের নিয়মিত দলের পাশাপাশি যোগ দিলেন নির্মাতা আতিক জামান, কলসিন্দুরের অদম্য মেয়েদের গল্পে যিনি ছিলেন সহযোগী পরিচালক। আমার এই সময়ের পছন্দের ব্যস্ততম চিত্রগ্রাহক নাজমুল হাসান অল্প সময়ের ব্যবধানেই ব্যবস্থা করে ফেললেন শিডিউল।

দল চলল লোকেশন পরিদর্শনে।

শুরুতেই আমরা বাধাগ্রস্ত হলাম যাঁদের পরিবারের বাল্যবিবাহ ঠেকানো হয়েছে তাঁদের বাড়িঘরে শুটিংয়ের অনুমতি চেয়ে। কিছুতেই তাঁরা ক্যামেরার সামনে আসবেন না, এমনকি তাঁদের বাড়িতে শুটিংও করতে দেবেন না।

আমরা মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। ঠিক করলাম শুধু এই চরিত্রগুলো পুনর্নির্মাণ করব। আর সত্য ঘটনার অবলম্বনে তুলে ধরব সাত সাহসীর গল্প। এই সাত সাহসী হলো নবম শ্রেণির তুলি দেবনাথ, সানজিদা ইসলাম ও স্নেহা বর্মণ এবং অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী লিজুয়ানা তাবাসসুম, জান্নাতুল ইসলাম, জীবননিসা খানম ও জান্নাতুল আক্তার।

সাত সাহসী ক্যামেরার সামনে তাদের প্রতিটি ঘটনা তুলে ধরতে অকুতোভয়। আর তাদের পরিবার তথা স্কুল থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে শুরু হলো শুটিংয়ের সব প্রস্তুতি।

শুটিং এডিটিং

শুটিংয়ের দুদিন আগেই আতিকের নেতৃত্বে কনক পপকর্ন দল পৌঁছাল লোকেশন ময়মনসিংহের নান্দাইলে। উদ্দেশ্য সাত সাহসীকে আরও ভালোভাবে জেনে তাদের ক্যামেরার সামনে সাবলীল করা। আমরা ভয় পাচ্ছিলাম, কারণ তারা তো পেশাদার শিল্পী নয়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ক্যামেরার সামনে নিজেদের প্রতিবাদের গল্প রূপায়ণ করতে একটুও অস্বস্তিতে পড়েনি তারা। আসলে এরা তো মনের জোরে বলীয়ান।

সাত সাহসীকে যেমন তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহায্য করেছিলেন গ্রামবাসী, স্কুলের শিক্ষক, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশ প্রশাসন সবাই। আমাদের শুটিং দলকেও সহযোগিতা করছেন সবাই। না হলে আবাসিক হোটেল নেই, এমন পাড়াগাঁয়ে শুটিং করা আরও কষ্টকর হয়ে পড়ত।

শুটিং মানেই ঘটনা

সাত সাহসীর শুটিংয়েও হয়েছে নানান কিছু। নদী পার হয়ে শুটিং দলকে পৌঁছাতে হবে পরের লোকেশনে। যে মাঝির নৌকায় পার হওয়ার কথা, তিনি অপর পাড়ে নৌকা রেখে কোথায় জানি চলে যান। অগত্যা ইউনিটের একজন সাঁতরে নৌকা নিয়ে আসেন, তারপর নদী পার হয় পুরো ইউনিট।

শুরুর দিকে ক্যামেরায় আলোর হিসাবনিকাশ বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল মেয়েদের। বারবার এনজি শট দিচ্ছিল। কিন্তু অবাক ব্যাপার খুব অল্প সময়েই তারা রপ্ত করে ফেলল। এরপর ক্যামেরা লাইট শুটিং ইউনিট সবই যেন বন্ধু হয়ে গেল ওদের।

এরই মধ্যে ঘটল আরেক অঘটন। তুলির শট চলছিল, পরের শট ছোঁয়ার, হঠাৎ দেখা গেল সে নেই। নেই তো নেই এবং তার কোনো মোবাইল ফোনও নেই যে যোগাযোগ করা যাবে। খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল আজ ছোঁয়ার জন্মদিন, সে পরিবারের কাছে চলে গেছে কেক কাটতে।

শেষ পর্যন্ত দুই ঘণ্টা পর আবার শুরু হলো শুটিং।

শেষ দৃশ্যে সাত সাহসী বীরত্বের সঙ্গে এগিয়ে আসবে ক্যামেরার দিকে, সব আয়োজন শেষ, শট নেওয়ার পালা কিন্তু এবার আবার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শ্যামাকে।

কী হলো!

সহকারী পরিচালকেরা গলদঘর্ম তাদের বোঝাতে, একজনের জন্য পুরো দলের কাজ আটকে থাকে।

অবশেষে শ্যামা ঢুকল শুটিংয়ে, সঙ্গে বড় একটা বাটিতে নুডলস। বেচারি মনে করেছে শুটিংয়ের সবাই এত কষ্ট করছে, নিজের হাতে কিছু আপ্যায়ন করি।

এ রকমই সবার ভালোবাসার ছোঁয়ায় ঘটন-অঘটনে এগিয়ে চলে সাত সাহসীর শুটিং।

শুটিং শেষে মাহবুব টিপুর সম্পাদনায় ও চিরকুট ব্যান্ড দলের নীরবের আবহ সংগীতের পর ফাইনাল কাট তৈরি হলো সাত সাহসীর। মনে আছে সম্পাদনার টেবিলে বসে যখন ফুটেজগুলো দেখছিলাম তখন সাত সাহসীর সঙ্গে নিজের বুকটাও ফুলে উঠছিল। এরাই বাংলাদেশের সাহসের বীজ, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যায় বীরদর্পে।

সাত সাহসীর নেপথ্যে

পরিচালনা

রেদওয়ান রনি

আতিক জামান

পরিকল্পনা

আনিসুল হক

চিত্রগ্রহণ

নাজমুল হাসান

সম্পাদনা

মাহবুব টিপু

আবহ সংগীত

জাহিদ নীরব (চিরকুট)

প্রযোজনা

পপকর্ন এন্টারটেইনমেন্ট

তথ্যচিত্রটি দেখুন:

ফেসবুক পেজ: facebook.com/DailyProthomAlo

ইউটিউব: https://goo.gl/8LKZtK