প্রজন্মের বুকে বাংলাদেশ

মাঠে ভালো খেলছে বাংলাদেশ। গ্যালারিতে আনন্দ উচ্ছ্বাসে উড়ছে লাল–সবুজ পতাকা। যেকোনো বিজয় বুকে বাজে দারুণ সুরে। ছবি: শামসুল হক
মাঠে ভালো খেলছে বাংলাদেশ। গ্যালারিতে আনন্দ উচ্ছ্বাসে উড়ছে লাল–সবুজ পতাকা। যেকোনো বিজয় বুকে বাজে দারুণ সুরে। ছবি: শামসুল হক

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের তরুণ প্রজন্ম ১৯৭১ দেখেনি, দেখেনি মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ক্ষণ। তবুও তাদের বুকে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বিজয়ের গৌরব। এই প্রজন্মের তরুণেরা মনে করেন, ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশের বিজয়, যেকোনো ক্ষেত্রে বাঙালির বিশ্বজয়, নিজের কাজ দিয়ে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলা-এসবই আসলে বয়ে নিয়ে যায় বিজয়ের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের আত্মদানের প্রতি শ্রদ্ধা এবং দেশপ্রেমের প্রকাশ আসলে কিসে-তাই বলেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের কয়েকজন উজ্জ্বল তরুণ

একটা ফুল, একটা পতাকা-আমার কাছে দেশপ্রেম
মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ঋণ আমরা এখনো শোধ করতে পারিনি। এই ঋণ আসলেই কি শোধ করা সম্ভব? নতুন দেশের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে তাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন। একমাত্র তাঁদের মতো আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখলেই সেই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান দেখানো যাবে। আর অনেকেই কিন্তু তা করছেন। পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে চোখের সামনে। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ থেকে শুরু করে ব্যাংকিং, ইন্টারনেট, কৃষি খাতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের পরিশ্রমই এসব পরিবর্তন এনে দিচ্ছে।
আমি জানি, আমাদের এখনো অনেক দূর যেতে হবে। তবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে আমরা ঠিক পথেই যাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতেই পৃথিবীর বুকে আমরা সেই বাংলাদেশ পাব, যার জন্য প্রাণ দিয়েছেন আমাদের লাখ লাখ শহীদ।
দেশপ্রেমের সংজ্ঞা আমার কাছে একটু অন্য রকম। অনেকটা ফুলের মতো, যার পেছনে ভালোবাসার যুক্তিসংগত কারণ হয়তো ঠিক খুঁজে পাওয়া যায় না কিন্তু গভীরতাটা টের পাওয়া যায় ঠিকই। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। একটা ফুল, একটা প্রিয় মুখ, একটা পতাকা-আমার কাছে এ নিয়েই দেশপ্রেম!
ওয়াহিদ ইবনে রেজা
অ্যাসোসিয়েট প্রোডাকশন ম্যানেজার, সনি পিকচার্স ইমেজওয়ার্কস (হলিউড), যুক্তরাষ্ট্র

কাজের মাধ্যমে শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা উচিত
আমি মেডিকেল-পড়ুয়া শিক্ষার্থী। আমার কাজ মানুষের সেবা-শুশ্রূষা করা। আমি এই কাজটিই আন্তরিকভাবে করতে চাই। আমার কাজ থেকে যেন সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়, অসহায় মানুষ চিকিৎসাসেবা পায়। দেশের বেশির ভাগ মানুষের স্বার্থের জন্য যাঁরা কিছু করেন, তাঁরাই দেশপ্রেমিক। দেশপ্রেম আসলে মানবপ্রেমেরই আরেক নাম।
মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদেরা আমাদের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছেন। আনুষ্ঠানিকতায় কোনো কিছু বাঁধা পড়ে গেলে তা কখনোই মঙ্গল বয়ে আনে না। তাই বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর আনুষ্ঠানিকতায় শ্রদ্ধাজ্ঞাপন আটকে না রেখে আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা উচিত। নিজেদের কাজ করেই আমরা তাঁদের প্রতি সম্মান জানাতে পারি।
রিজভী তৌহিদ
শিক্ষার্থী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় (২০১৬) প্রথম স্থান অধিকারী

এই লড়াই তো প্রতিদিনের
সেই ছোটবেলায় যখন স্কুলে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতাম, তখন মনে করতাম, এই জাতীয় সংগীত গাইলেই দেশকে ভালোবাসা হয়ে যায়। যখন বড় হচ্ছিলাম, তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম, দেশকে ভালোবাসা মানে দেশের উন্নতির জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে হয়। আর এই সময়ে যখনই জাতীয় সংগীত শুনি, আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। কেন এমন হয়, নিজেকে প্রশ্ন করেছি অনেকবার।
পত্রিকার পাতায় যখন দেখি বাংলাদেশের কেউ বিশ্ব জয় করেছেন, তখন আমার অনুভূতি নাড়া দেয়। এ দেশ নিয়ে কিছু একটা করার প্রেরণা পাই। প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো স্কুলশিক্ষক সারা জীবন অন্যকে আলোকিত করার চেষ্টায় থাকেন, কেউ যখন বই নিয়ে ঘোরেন মানুষের বাড়ি বাড়ি কিংবা কিশোরীদের সংগঠন ‘ঘাসফুল’ যখন একের পর এক বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দেয়-তখন আমি এসবের মধ্যেই যেন খুঁজে পাই দেশপ্রেমের মানে। আর দেশপ্রেম কথাটা উচ্চারণ করলেই একটি শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা হলো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ মানেই মুক্তিযুদ্ধ, শহীদের আত্মোৎসর্গ। মুক্তিযুদ্ধ শুধু স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য ছিল না-ছিল মানুষের মুক্তি, মানুষ হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম তো শেষ হয়ে যায়নি। শহীদের আত্মোৎসর্গ একটি দিবসে কি শেষ হয়ে যাবে? তাঁদের আত্মত্যাগের চেতনা প্রতি মুহূর্তে বহন করতে হবে। আর এই লড়াই তো প্রতিদিনের। নইলে মায়ের মুখের মলিন হাসি নয়ন জলে ভেসে যাবে।
মামুনুল হক
প্রভাষক, নাট্যকলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।