রানির অতিথি

>

মানুষের জীবন মান উন্নয়নে দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা রাখছেন যেসব তরুণ, ২০১৪ সাল থেকে ব্রিটেনের রানির পক্ষ থেকে তাঁদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। দ্য কুইন্স ইয়াং লিডারস অ্যাওয়ার্ড শিরোনামের এই পুরস্কার দেওয়া হয় কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করা ৬০ জন তরুণকে। এবার বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক এবং ফেমের প্রতিষ্ঠাতা জায়বা তাহিয়া। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর তাঁরা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের হাত থেকে এ সম্মাননা গ্রহণ করতে যাবেন। খবর পেয়ে আমরা দুই তরুণকে আমন্ত্রণ জানালাম প্রথম আলোর কার্যালয়ে। কথা ছিল দুজন দুজনের সাক্ষাৎকার নেবেন, একজন লিখবেন আরেকজনকে নিয়ে। ১২ ডিসেম্বর তাঁরা এলেন। ফেসবুকে দুজনের পরিচয় ছিল আগেই, তবে প্রথম সাক্ষাৎ হলো এই প্রতিবেদনের সুবাদে। আমরা দুজনের হাতে কাগজ আর কলম ধরিয়ে দিলাম। দীর্ঘ সাক্ষাৎকার পর্বে তাঁরা একে অপরকে বললেন নিজের গল্প। একসঙ্গে রানির কাছ থেকে পুরস্কার নিতে যাবেন, ভেবে দুজনই বেশ রোমাঞ্চিত

জায়বা তাহিয়া,আয়মান সাদিক
জায়বা তাহিয়া,আয়মান সাদিক

জায়বার জয়যাত্রা: আয়মান সাদিক

একটি মেয়ে, যাঁর জন্ম বাংলাদেশে হলেও লেখাপড়ার জন্য তাঁকে অনেকটা সময় জন্মভূমির বাইরে কাটাতে হয়েছে। লেখাপড়া শেষে নিজ দেশে ফেরার পর এ দেশের অনেক নারীর করুণ জীবনযাত্রা ও তাঁদের প্রতি সহিংসতার চিত্র তাঁর ওপর একটা অন্য রকম প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব থেকেই নিজের ক্যারিয়ারের কথা খুব একটা না ভেবে তিনি একটা বিচিত্র কাজ করে বসলেন। বিভিন্ন বস্তি ঘুরে মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো শুরু করলেন। যেন তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তা দিতে পারেন, চার দেয়ালের গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে আত্মনির্ভরশীল হতে পারেন। ‘প্রজেক্ট আত্মরক্ষা’ শিরোনামে এভাবেই শুরু হয় জায়বা তাহিয়ার কার্যক্রম। ধীরে ধীরে তিনি গড়ে তোলেন ফিমেল এমপাওয়ারমেন্ট মুভমেন্ট বা ফেম নামের একটা সংস্থা।

এ কাজগুলো করতে গিয়ে তাঁকে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারণে বাংলাটা খুব ভালো ছিল না, কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে দ্রুত। নানা কটুকথা, এমনকি হুমকিও কানে এসেছে। বস্তির অনেকে বলেছে, ‘এই মেয়ে তো আমাদের মেয়েদের গুন্ডা বানাচ্ছে।’ জায়বা আর তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া মেয়েরা মিলেই এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠেছেন।

শুরুতে শুধু আত্মরক্ষা দিয়ে শুরু হলেও এখন মেয়েদের আরও নানা রকম দক্ষতা যেমন সাইকেল চালানো, কম্পিউটারের কাজ, বিভিন্ন পণ্য তৈরি ও বাজারজাতকরণ শেখানোর ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে। বস্তিতে যেহেতু আগুন লাগার ভয় থাকে, তাই ইলেকট্রনিকসের কাজ শিখে মেয়েরা নিজেরাই স্বল্পমূল্যে ‘ফায়ার সেফটি অ্যালার্ম’ তৈরি করেছেন। তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে।

জায়বা চাইলে নিজের গণ্ডির ভেতরে থেকেই কোথাও না কোথাও জায়গা করে নিতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে জায়বা প্রতিনিয়ত নানা প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিয়ে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এই বিষয়টিই আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। ভাবছি, একদিন কড়াইল বস্তিতে জায়বার স্কুলে যাব। নিশ্চয়ই একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হবে!

আয়মানের হাসিমুখ: জায়বা তাহিয়া

তারুণ্যের শক্তির কথা বলতে গেলে এখন অবধারিতভাবেই চলে আসে আয়মান সাদিকের নাম। সম্ভবত তাঁর হাসির কারণেই সে অনেকের কাছে পরিচিত। হাসিমুখে সব কঠিন সমস্যার সমাধান তাঁর মতো করে আর কে বলতে পারে! প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া একটা ছোট্ট বাচ্চা থেকে শুরু করে ৭৫ বছরের বুড়োও তাঁর ‘ছাত্র’। আয়মানের সঙ্গে যেদিন মুখোমুখি বসার সুযোগ হলো, সেই দিনটা আমি সব সময় মনে রাখব। তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে বসে আমাকে তেমন কোনো প্রশ্ন করতে হয়নি। ১০ মিনিটের মধ্যে আয়মান তাঁর পুরো গল্পটা আমাকে বুঝিয়ে বলেছেন। এটাই টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, আয়মান সাদিকের জাদু!

জেনে অবাক হলাম, আয়মান যে সব সময় একজন শিক্ষকই হতে চেয়েছিলেন, তা নয়। বাবা সেনাবাহিনীতে আছেন, তাই আর্মি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তিনি বড় হয়েছেন। যদিও শিক্ষামূলক ভিডিও তৈরির মাধ্যমে একটা অনলাইন স্কুল চালু করার সঙ্গে তাঁর ছোটবেলার স্বপ্নের কোনো যোগসূত্র নেই, তবে আয়মান মনে করেন, শৃঙ্খলা আর বিনয় তিনি তাঁর পরিবার থেকেই পেয়েছেন। তিনি নাকি একটা সময় প্রকৌশলীও হতে চেয়েছিলেন। অবশ্য এখন তিনি যা করছেন, সেই কাজটা ‘প্রকৌশল’ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। একজন প্রকৌশলীর মতোই তিনি কঠিন সব সমস্যার সমাধান বলে দেন তাঁর সহজাত সাবলীল ভঙ্গিতে। নিজের মেধা কাজে লাগিয়ে তিনি সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন।

আয়মান জানালেন, প্রতিদিন দেড় লক্ষ ছাত্রছাত্রী টেন মিনিট স্কুলের সহায়তা নিচ্ছে। তবে তাঁর দাবি, এটা একটা বিশাল কার্যক্রমের ছোট্ট একটা অংশ মাত্র। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মাসেই আসছে টেন মিনিট স্কুলের মোবাইল অ্যাপ। প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে এই অ্যাপ, যেন ছেলেমেয়েরা আনন্দের সঙ্গে তাদের পড়ালেখার বিষয়গুলো গ্রহণ করতে পারে। শুধু একাডেমিক শিক্ষাই নয়, বিভিন্ন মানবিক কৌশল শেখানোর পরিকল্পনাও আছে আয়মানের।

শুরুর দিকে আমার ধারণা ছিল, আয়মানের মুখের পূর্ণদৈর্ঘ্য হাসিতে আসলে সাফল্য আর একাধিক পুরস্কার জয়ের আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে। কিন্তু আলাপ করতে করতে বুঝলাম, এই হাসি আসলে আশার প্রতীক। এই হাসিই বাংলাদেশের তরুণদের ইতিবাচক হতে শেখায়, অনুপ্রাণিত করে।