রেফারি জয়ার জয়
সবুজে ঘেরা পাহাড়, শুভলং ঝরনা, ঝুলন্ত ব্রিজের কিছুই তাঁকে টানত না। রাঙামাটির মেয়ে জয়া চাকমার মন সারাক্ষণ পড়ে থাকত ফুটবল মাঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বন্ধুরা যখন ক্যারিয়ার গড়তে বিসিএসের হলে বসছেন, জয়া তখন ব্যস্ত™ফুটবলের নিয়মকানুন শিখতে। জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার জয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনাকারী রেফারি। যদিও এরপরে বাংলাদেশের আরেকজন রেফারি সালমা আক্তারও আন্তর্জাতিক ম্যাচ চালিয়েছেন। গত ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৫ মহিলা সাফে দুটি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন জয়া।
ছোটবেলায় স্কুলে ১০০ ও ২০০ মিটারে দৌড়াতেন। শিশু একাডেমির প্রতিযোগিতায়ও একাধিকবার অংশ নিয়েছেন। একসময় হ্যান্ডবলও খেলতেন। তবে ফুটবলটাই ছিল জয়ার ধ্যানজ্ঞান। ২০০৬ সালে রাঙামাটিতে মাস তিনেকের একটা ফুটবল ক্যাম্প করেন। এরপর ঢাকায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার আন্তজেলা ফুটবলে অংশ নিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন করেন রাঙামাটিকে। অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য জাতীয় দলে ডাক পান জয়া। ঘরোয়া ফুটবলের পাশাপাশি ইন্দো-বাংলা গেমস, এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ বাছাই টুর্নামেন্ট ও ২০১০ এসএ গেমসে খেলেছেন তিনি। ২০১২ সালে দল থেকে বাদ পড়লে আর খেলাটা চালিয়ে যাননি। এরপর বিজেএমসিতে চাকরি হয়ে যায় জয়ার। ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে।
ফুটবলার ছিলেন বলেই রেফারিংয়ে আগ্রহী হন জয়া। বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি ব্যক্তিত্ব স্টিভ জবসের একটা কথা সব সময় মনের মধ্যে ঘুরত তাঁর। রেফারি হওয়ার গল্পটা বলতে গিয়ে জয়া বলছিলেন, ‘ক্যারিয়ারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সংশয়ে ভুগছিলাম। ব্যাংক বা বিসিএসের জন্য পড়তে গেলে আমাকে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। কিন্তু এরই মধ্যে অন্যদের চেয়ে একটা জায়গায় আমি একটুখানি হলেও এগিয়ে আছি। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা করেছি। ওদের থেকে আমার ছোট এই পার্থক্যটাই সারা জীবন একটা বড় পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে। আমার মনে হয়েছে খেলাধুলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাই ঠিক হবে। এরপরই রেফারিংয়ে জন্য পরীক্ষা দিলাম।’
২০১২ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে নিয়মিত রেফারিং শুরু জয়ার। এরপর একে একে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা পরিচালনা করেছেন শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও তাজিকিস্তানে। ২০১৫ সালে বার্লিনে আন্তর্জাতিক ফুটবল উৎসবে ১০টা ম্যাচ পরিচালনা করেন। ঢাকায় এবার সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টে চালিয়েছেন দুটি ম্যাচ।
যখন বাংলাদেশে মহিলা কোচের সংস্কৃতি শুরু হয়নি ওই সময় রেফারিংয়ের চ্যালেঞ্জটা নেন জয়া। চ্যালেঞ্জটা স্বাচ্ছন্দ্যেই নিয়েছেন তিনি, ‘দেশের বাইরে গেলে অনেকেই প্রশ্ন করে তুমি কোন ক্যাটাগরিতে রেফারিং করো? যখন শোনে আমি এখনো ফিফা রেফারি হয়নি, তখন একটু অবাক হয়। বেশি অবাক হয় বাংলাদেশে কোনো ফিফা নারী রেফারি নেই শুনে।’
খেলাধুলায় জয়াকে এনে দিয়েছে শক্ত অবস্থান। জয়ার মতে, ‘খেলাধুলা আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে, আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। স্বাবলম্বী করেছে। সম্মানও দিয়েছে।’
প্রথম নারী রেফারি হিসেবে জার্মানির বুন্দেসলিগার ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন বিবিয়ানা স্টেইনহস। তাঁকেই আদর্শ মানেন জয়া। বাংলাদেশেও ছেলেদের ম্যাচ পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে জয়ার। তবে সেটি পাইওনিয়ার ও তৃতীয় বিভাগে। এখনো প্রিমিয়ার লিগ বা চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে কোনো ম্যাচ পরিচালনা করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আন্তবিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। ক্যারিয়ারের প্রথম লাল কার্ডটাও দেখিয়েছিলেন এক পুরুষ ফুটবলারকে। সেই ঘটনা বলেন আর হাসেন জয়া, ‘আন্তবিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচের খেলায় একটা ছেলে মারাত্মক ফাউল করে। ওকে লাল কার্ড দেখালাম। ও তো হতবাক হয়ে গেছে! ভাবতেই পারেনি আমি ওকে লাল কার্ড দেখাব। একটু রাগও করেছিল। খেলা শেষ করে আমার কাছে এসে ঘটনা বুঝতে পেরে ক্ষমা চায়। পরে আমি রাতে তাকে বটতলায় নিয়ে গিয়ে খাবার খাওয়ালাম।’ বাবা-মাও খুব উৎসাহ দিতেন তাঁদের বড় মেয়েকে। জয়ার বাবা সঞ্জীবন চাকমা ছিলেন কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের কর্মকর্তা। বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। আর মা মালতি চাকমা রাঙামাটিতে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। জয়া বলেন, বাবা একসময় ভলিবল খেলতেন। তাই আমাদের তিন বোনকে খেলাধুলার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। এক বোন বেতারে উপস্থাপনা করেন। আরেক বোন কলেজে পড়ার পাশাপাশি কারাতে খেলেন।
জয়া সম্প্রতি বিকেএসপির কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। বিকেএসপির নারী ফুটবল দলটিকে ভারতে নিয়ে ‘সুব্রত মুখার্জি গোল্ডকাপ’ চ্যাম্পিয়ন করেছেন। ওই টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুসারে সেরা কোচেরও পুরস্কার পান।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই অবস্থানে এসেছেন জয়া। শুরুর দিনগুলোর কথা মনে করে বলছিলেন, ‘প্রথম দিকে অনেকে ইভটিজিং করত। অনুশীলনে গেলে বিরক্ত করত। কিন্তু ক্যাম্পে ওঠার পর সব বদলে গেল। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরাও উৎসাহ দিত।’
প্রথম দিকে তো অনেকে নিরুৎসাহিতও করেছেন রেফারিংয়ের ব্যাপারে। তিনি বলেন, প্রথম যখন রেফারিং শুরু করি তখন অনেকে বলত, পাগল নাকি? এসবে টাকাপয়সা নেই। কেন যাবি? আর তুই কি দেখেছিস মেয়েরা কখনো রেফারিং করে? ওদের নেতিবাচক কথার মধ্যে আমি ইতিবাচক কিছু খুঁজে পেয়েছি। আমি হতে চেয়েছি প্রথম।’
জয়া দেখেন একদিন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ পরিচালনা করবেন। যদিও একবার এমন একটা ম্যাচ পরিচালনা করেছেন, ‘জার্মানির ফুটবল ফেস্টিভ্যালে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ম্যাচ চালিয়েছি। যদিও ওটা ছিল ওদের একাডেমির দল।’
তাজিকিস্তানে ও নেপালে বাংলাদেশ এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন যখন বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল খুব কাছ থেকে দেখেছেন মেয়েদের শিরোপা উদ্যাপন। আঁখি-তহুরা-কৃষ্ণাদের নিয়ে অনেক গর্ব জয়ার, ‘এটা বিশাল সম্মানের ব্যাপার। যখন বাংলাদেশ ভালো করে তখন ওই দেশের রেফারিকেও আলাদা চোখে দেখা হয়। ওদের নিয়ে সত্যি গর্ব করি আমি।’
ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েরা একদিন বিশ্বজয় করবে, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পতাকা বুকে ধরে বাঁশি বাজাবেন জয়া। সেই স্বপ্ন মনের মধ্যে পুষে রেখেই জয়া নিরন্তর বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন।