জীবন বিলি করা এক জেবুন নেসা

জেবুন নেসা। ছবি: জাহিদুল করিম
জেবুন নেসা। ছবি: জাহিদুল করিম

নিজের জীবনে অনেক আপনজন হারিয়েছেন জেবুন নেসা। সর্বনাশা ক্যানসার একে একে তাঁর অনেক স্বজনকে কেড়ে নিয়েছে। এই বুকচাপা কষ্ট বয়ে বেড়াতে বেড়াতে তিনি বেছে নিয়েছেন মহান এক ব্রত। তা হচ্ছে সুস্থ থাকতে অন্যকে সচেতন করে তোলা।

৬৪ বছর বয়সী জেবুন নেসার সংগ্রামটি একটু অন্য রকম। তিনি শুধু নিজে সুস্থ থাকতে চান না, সুস্থ রাখতে চান আশপাশের সবাইকে। তাঁর ব্যাগে সব সময় কাগজপত্র থাকে। নিজেই বিলি করেন সেই কাগজ। অনুরোধ করেন, অন্ততপক্ষে কাগজগুলো যাতে পড়েন, সেখানে সুস্থ থাকার কৌশল লেখা রয়েছে। কেউ কেউ কথা রাখেন। তবে বেশির ভাগই কথা রাখেন না।

হেলদি এনার্জেটিক অ্যাকটিভ লাইফ (হীল) বা হেলদি সবল কর্মময় জীবন নামক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জেবুন নেসা। কেবিন ক্রু হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে কাজ শুরু করেন। চিফ পার্সার হিসেবে অবসর নেন। মা, নানি, খালা, মামাতো বোন, খালাতো বোন, খালাতো ভাইকে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মরতে দেখেছেন। বর্তমানে তাঁর পরিবারের তিনজন ক্যানসারে আক্রান্ত। অন্যদিকে, স্বামী বাংলাদেশে প্রথম সরকারি অনুদানে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’-র পরিচালক মসিহউদ্দিন শাকেরের পরিবারের সাত সদস্যও ক্যানসারে মারা গেছেন। দুই পরিবারে এত আপনজনের মৃত্যুতে জেবুন নেসা মুষড়ে পরেন। তবে হাল ছাড়েননি।

জেবুন নেসা বলছিলেন, স্বামী মসিহউদ্দিন শাকেরের বাবা জালাল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রথম ব্লাড ক্যানসারের রোগী। তাঁর দাদা গলা দিয়ে রক্ত পড়ে মারা যান। পরিবারের বেশির ভাগ পুরুষ ৪০ বছরের বেশি বাঁচেননি।

শিল্পকলা একাডেমিতে সম্প্রতি স্বামীর ৭০তম জন্মদিন উদ্‌যাপন করলেন জেবুন নেসা ও পরিবারের সদস্যরা। সুস্থভাবে স্বামীর এই বেঁচে থাকাটাকে সৃষ্টিকর্তার বিশেষ আশীর্বাদ হিসেবে দেখার পাশাপাশি এই বয়সেও স্বামী ও স্ত্রী মিলে যে সুস্থ জীবন কাটাচ্ছেন, এর পেছনে কিছু নিয়মকানুন কাজ করছে বলেই জানালেন জেবুন নেসা। বললেন, ‘এই কথাগুলোই অন্যদের বলতে চাই। বলি, কিছু নিয়মপালন করে দেখেন, যদি আরাম পান, ভালো লাগে, তাহলে তা মানলেন। এতে ক্ষতি তো কিছু নেই।’

কয়েক দিন আগে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে কথা হয় জেবুন নেসার সঙ্গে। কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রথম আলোর বিভিন্ন কর্মীর কাছেও তিনি তাঁর সংগঠনের পক্ষ থেকে বের করা বিভিন্ন লেখা বিলি করছিলেন। জানালেন, প্রায় ৩৫ বছর আগে স্বামীর আলসারেটিক কোলাইটিস (প্রি-ক্যানসার) ধরা পড়লে চিকিৎসকেরা কোলন ফেলে দিতে বলেন। তিনবার তা অস্ত্রোপচার করে ফেলা দেওয়ার স্টেজে গেলেও পরে আর তা করতে হয়নি। এটি হয়তো ‘হেলদি লাইফস্টাইল’ ফলো করার ফল। সুস্থ থাকতে হলে ৮০ শতাংশ পুষ্টি এবং ২০ শতাংশ ব্যায়াম প্রয়োজন হয়। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে সারা দিনে ৫ ভাগের ১ ভাগ সময় দিতে হবে ব্যায়ামে। এ ছাড়া শরীর ভালো রাখতে ঠিকমতো শ্বাস নিতে বিশুদ্ধ অক্সিজেন, শরীরের বর্জ্য ঠিকমতো বের হওয়ার পাশাপাশি নানি-দাদিরা যেভাবে শরীরে তেল মালিশ করতেন, তাও জরুরি। ভাপ নিলেও শরীর ভালো রাখা যায়।

জেবুন নেসা ভাপ নেওয়ার পদ্ধতিও জানালেন। তিনি বললেন, ৫০০ গ্রাম চালের ভাতের পাতিলে পানি ও বড় রসুন কুচি দিয়ে ফুটাতে হবে। চুলার আঁচ কমিয়ে পানিতে দুই টেবিল চামচ কালোজিরা, আটটি তেজপাতা দিয়ে পানি ফুটানোর পর পানি এক-তৃতীয়াংশ কমলে তাতে ভাপ নিতে হবে।

জেবুন নেসা গর্বের সঙ্গেই জানালেন, তিনি এবং তাঁর স্বামী ৩৫ বছর ধরে ঘুমের ও ব্যথার ওষুধ এবং অ্যান্টাসিড খাননি। জ্বর এলেও ওষুধ খান না।

নয় ভাইবোনের (এক ভাই মারা গেছেন) মধ্যে জেবুন নেসা সবার বড়। আট মাস বয়স থেকে জেবুন নেসা অ্যাজমায় ভুগছেন। এইচএসসি পরীক্ষার সময় মা মারা যান। পরে বাবাও মারা যান। ১৯৭৭ সাল থেকে বিমানে কেবিন ক্রু হিসেবে প্রায় ৩০টি দেশে গেছেন। কেবিন ক্রুদের দিনের ১৬ ঘণ্টা নিজেদের ফিট রাখতে হয়। তখন থেকেই নিয়ন্ত্রিত জীবনের প্রশিক্ষণ পান, পরে এই প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে শুধু চাকরি না, নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নেন।

ভাইবোনদের মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে নেন ছোট বয়সেই। গ্রিসের এথেন্সে কেবিন ক্রু হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় একবার ডিওডেনাল আলসার বার্স্ট হয়। তখন চিকিৎসক জানান, টেনশন থেকে মুক্ত হতে না পারলে জেবুন নেসাকে কেউ ভালো করতে পারবে না। শরীর নিয়ে জানতে হবে, জীবনকে সহজ করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেন জেবুন নেসা। তারপর থেকেই টেনশন কমানোর জন্য প্রতিদিন যোগব্যায়ামের পাশাপাশি চলতে থাকে অন্যান্য ব্যায়াম। পরিমাণমতো প্রাকৃতিক খাবার খাওয়া শুরু করেন। এথেন্সের ঘটনার পর আরও ২৪ বছর বিমানে চাকরি করেন জেবুন নেসা। নিজের পরিবার, স্বামীর অসুস্থতা ও একমাত্র মেয়েকে মানুষ করার জন্য চাকরি ছাড়ার কোনো উপায় ছিল না।

জেবুন নেসা ছয় বছর ধরে ‘হীল’ নামক সংগঠন চালিয়ে সংগঠনের সদস্য করতে পেরেছেন মাত্র ৮০ জনকে। তবে জেবুন নেসা প্রায় ২০টি সংগঠনের সদস্য হয়েছেন। বললেন, ‘সুস্থ থাকার কৌশল জানানোর জন্য নিজেদের সংগঠনের টাকাপয়সার অভাব আছে। বিভিন্ন কাজে মানুষ টাকা খরচ করলেও এ কাজের জন্য কেউ টাকা খরচ করতে চান না। বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে মানুষকে সুস্থ থাকার কথা বলতে পারি।’

জেবুন নেসার মতে, বাড়তি খাওয়াটাই অসুখ। পরিমিত খাবারের পাশাপাশি ১০ বছর ধরে তাঁরা তেল ছাড়া রান্না করা তরকারি খান। ভেজালের হাত থেকে বাঁচতে সব শাকসবজি তিন ঘণ্টা পানিয়ে ভিজিয়ে রাখেন। খাবারের তালিকা থেকে ময়দা দিয়ে তৈরি খাবার এবং সাদা চিনি একদম বাদ। সব ধরনের পানীয় বাদ। খাবারের তালিকায় প্রতিদিন থাকছে সাত রকমের ফল ও সাত রকমের সবজি। ঘরের বেশির ভাগ কাজ স্বামী ও স্ত্রী নিজেরাই করেন। তিল, তিসি, বাদামের মতো খাবারগুলোকে প্রাধান্য দেন। ঘর ও শরীরকে পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টিতেও থাকে সর্বোচ্চ সতর্কতা।

বিমানে চাকরির সুবাদে কম করে হলেও ৩০টি দেশের মানুষ সুস্থ থাকার জন্য কোন কোন পদ্ধতি মেনে চলে, তা জানা ও শেখার চেষ্টা করেছেন জেবুন নেসা। শেখা কথাগুলোই বাংলায় সহজ করে লিখে তা বিলি করেন জেবুন নেসা।

জেবুন নেসা দম্পতির এক মেয়ের বয়স ৩৩ বছর। স্বামীর সঙ্গে সিডনিতে থাকেন মেয়ে। জেবুন নেসা জানালেন, ছোটবেলা থেকে মেয়েকেও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত করেছেন। মেয়ের জামাইও বিষয়টি পছন্দ করেছেন এবং নিজের জীবনে মেনে চলার চেষ্টা করছেন। একদিন হয়তো মেয়ে ও মেয়ের জামাই তাঁর সংগ্রামের হাল ধরবেন, সে আশাতেই আছেন জেবুন নেসা।

রোগ প্রতিরোধে ১০টি ভালো অভ্যাস: জেবুন নেসা তাঁর লেখায় ১০টি অভ্যাসের কথা বলেছেন।

সকালে খালি পেটে প্রায় তিন গ্লাস পানি খেতে হবে। তারপর শবাসনে ১০ মিনিট শুয়ে থাকতে হবে। এরপর ৩৫ মিনিট কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। দুপুরে বা রাতে খাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে ২ গ্লাস ও ১ ঘণ্টা পরে ২ গ্লাস পানি খেতে হবে।

পেটে জমা গ্যাস বের করতে নাশতার আগে চিৎ হয়ে শুয়ে তিনভাবে পেট ঘষতে হবে। সপ্তাহে এক দিন উপোস থাকা ভালো।

প্রতিদিন খোলা জায়গায় ৪৫ মিনিট জোরে হাঁটা, প্রতিদিন এক ঘণ্টা কায়িক শ্রম বা ঘরের কাজ করতে হবে।

শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য যোগব্যায়াম করতে হবে।

সব সময় মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসতে হবে। শক্ত বিছানায় চিৎ হয়ে অথবা ডান দিকে পাশ ফিরে সোজা হয়ে শুতে হবে।

সারা দিনের খাবারে ৩ ভাগের ১ ভাগ রান্না করা খাবার বাকিটা ফল, শাকসবজির সালাদ দিয়ে পূরণ করতে হবে। সাদা চিনি ও ময়দায় তৈরি খাবার এবং পানীয় থেকে দূরে থাকতে হবে।

প্রতিদিন সাত রকমের ফল ও সাত রকমের সবজির পাশাপাশি স্বল্প পরিমাণে আদা, কাঁচা হলুদ ও গোলমরিচ একসঙ্গে খেতে হবে। দুপুরের খাবারের সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ ও কয়েক কোয়া কাঁচা রসুন খেতে হবে।

প্রতিদিন মুগডালের পাতলা স্যুপ তেল ছাড়া রান্না করে খেতে হবে।

ভাজাপোড়া ও তেলচর্বি-জাতীয় খাবার এবং তামাকসহ সব ধরনের নেশা থেকে দূরে থাকতে হবে।

মনকে সব সময় প্রফুল্ল রাখতে হবে।